একদিকে দেশকে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন নেতারা, অন্যদিকে নাকি আত্মহত্যায় বিশ্বের শীর্ষ স্থান দখল করেছে ভারত। সমীক্ষা জানাচ্ছে, প্রতিদিন গড়ে ১৬০ জন ভারতীয় নিজেকে শেষ করে দেন। সেই দলে তরুণ-তরুণীদের সংখ্যাই বেশি। আর কী জানাচ্ছে সমীক্ষা? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
চেষ্টা করেও সাফল্য মেলেনি। একবার নয়, বারবার। এই পরিস্থিতিতে পরিবার পরিজনের পাশে থাকা আশ্বাস ম্যাজিকের মতো কাজ করে। প্রেরণা দেয় নতুন উদ্যমে চেষ্টার। কিন্তু না, যেটুকু জুড়ে অসফলতার ক্ষত, সেটুকুই বারবার বিদ্ধ হয়েছে কথার বাণে। কারও ক্ষেত্রে পরিবার, কারও প্রতিবেশী, কারও আবার কাছের মানুষ। তাই নিজেকে শেষ করে ফেলার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। এ দেশে এমন মানুষের সংখ্যা এক নয়, কয়েক লক্ষ। প্রতিদিন অন্তত ১৬০ জন ভারতীয় আত্মহননের পথ বেছে নেন, এমনটাই জানাচ্ছে সাম্প্রতিক সমীক্ষা।
আত্মহত্যা মহাপাপ। এ কথা শাস্ত্রে বলে। আইনও এই মৃত্যুকে অপরাধের আখ্যা দেয়। আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে কড়া শাস্তির মুখে পড়তে হয়। তার সঙ্গে সমাজের অপমান তো রয়েছেই। তবু সব কিছু ছেড়ে পালিয়ে যেতে চান অনেকেই। এ পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর তাঁদের কাছে। জগতের সব আলো তাঁদের কাছে অন্ধকারে ঢাকা। কোনও আনন্দ নেই। কেউ পাশে থাকার নেই। মুক্তির একমাত্র উপায় আত্মহত্যা, এমনটাই মনে করেন এঁরা। গোটা বিশ্বেই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন হাজার হাজার মানুষ। তবে সব দেশকেই এ বিষয়ে পিছনে ফেলে দিয়েছে ভারত। আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ভারতের যে সংখ্যক মানুষ আত্মহত্যা করেন তা বিশ্বের সমস্ত দেশের মানুষের গড় আত্মহত্যার দ্বিগুণ। অর্থাৎ গোটা বিশ্বে আত্মহত্যার গড় যদি ১০০ হয়, ভারতে সেই সংখ্যাটা ২০০। পরিসংখ্যান বলছে ভারতে প্রতিদিন গড়ে ১৬০ জন আত্মহত্যা করেন। এক বছরে সেই সংখ্যাটা ১ লক্ষ ৭০ হাজার। সময়ের হিসাবে প্রতি ৮ মিনিটে একজন।
নিঃসন্দেহে এ তথ্য চমকে দেয়। তবে তার থেকেও বেশি অবাক হতে হয় আত্মহত্যা যারা করছেন তাঁদের বয়সের হিসাব দেখলে। সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে, আত্মহত্যার প্রবণতা সবথেকে বেশি এ দেশের যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে। ১৫ থেকে ৩৯ বছরের মধ্যে বয়স, এমন ভারতীয়রাই সবথেকে বেশি আত্মহননের পথে হাঁটছেন। কারণটা অনুমান করাও কঠিন নয়। বিশেষজ্ঞদের দাবি, বেকারত্বের জেরেই দেশে ক্রমশ বাড়ছে আত্মহত্যার সংখ্যা। কাজ পাওয়ার আশায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যেসব শহরে পাড়ি দেয় মানুষ, সেইসব শহরগুলিই কারও কারও কাছে দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে ওঠে। কারণ স্বপ্ননগরীতে এসেও জীবনে ভালভাবে বাঁচার স্বপ্নটা অধরাই থেকে যাচ্ছে তাঁদের কাছে। রুটিরুজি জোটাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেকের ক্ষেত্রে আবার কাজ থাকলেও কাজের চাপ মাত্রাছাড়া, তা সামলাতে গিয়ে উঠছে নাভিশ্বাস। সারাক্ষণ মাথার উপর ঝুলছে বাতিল হয়ে যাওয়ার ভয়। আর এঁদেরই কেউ কেউ হতাশার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে হেরে যাচ্ছেন একদিন। নিজের হাতেই শেষ করে দিচ্ছেন নিজেকে। আবার পড়ুয়াদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ার জন্য অতিরিক্ত চাপকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। মনে রাখা দরকার, দেশের বিভিন্ন নামী প্রতিষ্ঠানগুলিতে যাঁরা পড়াশোনা করেন, তাঁদের অধিকাংশকেই থাকতে হয় বাড়ি থেকে দূরে। সেখানে আবাসিক জীবন কড়া অনুশাসনে বাঁধা। অস্বাভাবিক নিয়ম, অগণিত পরীক্ষা, বিশ্রামহীন রুটিনের জন্য একরকম কুখ্যাতিই রয়েছে সেই কেন্দ্রগুলির। ভাড়াবাড়ি বা পেয়িং গেস্ট ব্যবস্থায় কোনও মতে থাকা, দিনে পনেরো-ষোলো ঘণ্টা পড়াশোনা, এক ঘণ্টা বেশি ঘুমোতে চাইলে কর্তৃপক্ষের ভর্ৎসনা ও ধিক্কার— এই জীবন হয়তো নিতে পারেন না অনেক পড়ুয়াই। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া কেরিয়ারের বোঝা বইতে গিয়ে তাই হাঁপিয়ে ওঠেন। তুমুল প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে ভয় হয় হেরে যাওয়ার, হারিয়ে যাওয়ার। অত্যধিক চাপ থেকে ঘিরে ধরে অবসাদ। আর অবশেষে, অন্য এক জীবনের খোঁজে এ জীবনকে ছুটি দেন তাঁরা। এ সবকিছু মিলিয়েই আত্মহত্যায় বিশ্বের শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছে ভারত। দেশের আর্থিক-বাণিজ্যিক উন্নয়নের দিকে জোর দেওয়ার পাশাপাশি দেশবাসীর সামগ্রিক মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব না দিলে যে হার বাড়বে বই কমবে না।