‘ওগো রাজা মুখটি খোলো, কও না ইহার কারণ কী?’- হাসির আড়ালে উপনিবেশের রাজাকে এ প্রশ্ন করেছিলেন সুকুমার রায়। আজকের মণিপুর থেকে কলকাতা, সে প্রশ্ন কিন্তু জীবন্তই রয়েছে। অতএব সুকুমার রায়কে মনে না রেখে আমরা করব কী?
কেউ কি জানে সদাই কেন বোম্বাগড়ের রাজা?
ছবির ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখে আমসত্ত্ব ভাজা?
সুকুমার রায় যখন কবিতায় এ প্রশ্ন তুলছেন, তখন দেশ পরাধীন। কিন্তু দেশে দেশে কালে কালে শাসকের আচরণে যে নানারকম অসংগতি থেকেই যায়, সে কথা তিনি জানতেন। যে কোনও সচেতন শিল্পী সাহিত্যিকই সে কথা জানেন। তাই রবীন্দ্রনাথ যক্ষপুরীর রাজার গল্প বলেন, চ্যাপলিন ফুটিয়ে তোলেন ডিক্টেটরের ছবি, আর সুকুমার রায় বলেন কোনও এক বোম্বাগড়ের রাজার গল্প- যে ছবির ফ্রেমে আমসত্ত্ব ভাজা বাঁধিয়ে রাখে, সভায় হুক্কা হুয়া বলে চেঁচায়, তার সিংহাসনে ভাঙা বোতল শিশিও ঝোলানো থাকে। অর্থাৎ তার রাজত্বে কী কী হয়, তার ফর্দটা আপাতদৃষ্টিতে অ্যাবসার্ড। শুধু রাজাই নয়, রাজ্যের বাকি যারা গণ্যমান্য, ওস্তাদ, পণ্ডিত, মন্ত্রী, রাজার খুড়ো বা পিসি, সবাই কিন্তু বিনা প্রতিবাদে, বিনা বাক্যব্যয়ে এই আস্ত ‘অ্যাবসার্ডিটি’র অংশ। কেউ রাজাকে সেই অসংগতি নিয়ে প্রশ্ন তো করেই না, উলটে নিজেরাও রাজার অনুপ্রেরণাতেই একইরকম অসংগত আচার আচরণ করে চলে।
আপাতদৃষ্টিতে এ কবিতা নিছক হাসির। কিন্তু যদি এভাবে ভাবা যায় যে বোম্বাগড়ের রাজা আসলে রাজত্বের নামে যা খুশি তাই করেন, এবং তাঁর বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলে উঠতে পারে না? নির্বোধ রাজাও যে সর্বশক্তিমান। ফলে তাঁকে মুখের উপর নির্বোধ বলার চেয়ে সেই নির্বুদ্ধিতার প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়া ঢের সহজ, উপরন্তু তাতেই রাজার প্রসাদ পাওয়ার পথও খোলে। অতএব আস্ত একটি সার্কাস দেখেও কারও প্রতিবাদের শিরদাঁড়া সোজা হয় না। এই ছবি সেকালে যেমন সত্যি ছিল, একালেও তেমনই সত্যি। শাসক আর প্রসাদপুষ্ট পরিজনদের আদলে রাজনীতির এক চিরন্তন ছবি এ কবিতার গায়ে ফুটে ওঠে। তা ছাড়া ক্ষমতার তালে তাল না দিলে কী ঘটবে, ‘কুমড়ো পটাশ’-এ তারই পরিষ্কার বিধান-
তুচ্ছ ভেবে এসব কথা করছে যারা হেলা,
কুম্ড়োপটাশ জানতে পেলে বুঝবে তখন ঠেলা।
ঠেলা বোঝার হাত থেকে বাঁচতে হলে ক্ষমতার ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলা সং’ হওয়াই ভালো। তাই কুমড়োপটাশ হাসলে এক ঠ্যাঙে রান্নাঘরের পাশে খাড়া থাকতেও হবে, কিংবা দরকার হলে হট্টমুলার গাছে উলটো করে ঝুলে থাকতেও হবে। বোম্বাগড়ের রাজা যা খুশি করে নিজে সুখ পায়, আর এক ধাপ এগিয়ে কুমড়োপটাশ কিন্তু সুনিশ্চিত করতে চায় যে তার বিভিন্ন অভিলাষের ইঙ্গিতে জনগণেশ কীভাবে সাড়া দেবে।
আসলে প্রভূত ক্ষমতা যখন হাতে আসে, বিরোধী স্বর যখন জমি পায় না, তখন শাসক যা-ইচ্ছে-তাই করে ফেলার লাইসেন্স পেয়ে গিয়েছে বলে ভাবে। আর সেই প্রেক্ষিতেই রাজনীতি পরিণত হতে পারে ক্ষমতার ননসেন্সে। ননসেন্স কবিতার বয়ানে এ কথাও কি একভাবে লিখে যাননি সুকুমার রায়? তাঁর ‘আবোল তাবোল’ বইয়ের মুখবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘কৈফিয়ত’, যেখানে সুকুমার লেখেন- “যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার।” ‘আজগুবি’, ‘উদ্ভট’, ‘অসম্ভব’ শব্দের পাশেই আছে ‘কারবার’- অনন্ত অবাস্তবের সঙ্গে কবি মিশিয়ে দিচ্ছেন কড়া ‘অর্থময়’ লেনদেনের বার্তা। সর্বশক্তিমান ক্ষমতার চেহারাটা উপর থেকে যতই আজগুবি ঠেকুক, তার আড়ালে দুর্নীতির ঘোর বাস্তব খেলা চলতেই থাকে। তাই ক্ষমতার মধ্যেও বাস্তব-অবাস্তবের যেমন সহাবস্থান, আবার ক্ষমতার উদ্ভট আচরণ আর জনমানসের স্পষ্ট প্রতিবাদের মধ্যেও অবাস্তব আর বাস্তবের সংঘর্ষ।
বাস্তবের দুনিয়ায় আমরা জানি, সেই প্রতিবাদকে নানাভাবে টুঁটি টিপে মারতে চায় শাসক। ক্ষমতার সবচেয়ে বড় দোসর শাসকের হাতে থাকা পুলিশ প্রশাসন আইন, চিন্তক আলথুজার যাকে বলবেন রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস। শাসককে চটালে কী হতে পারে, তারই ফর্দ আছে ‘একুশে আইন’-এ-
চলতে গিয়ে কেউ যদি চায়,
এদিক ওদিক ডাইনে বাঁয়,
রাজার কাছে খবর ছোটে,
পল্টনেরা লাফিয়ে ওঠে,
দুপুর রোদে ঘামিয়ে তায়
একুশ হাতা জল গেলায়৷
একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, অবিশ্বাস্যের নানা রংদার উপস্থাপনা মিশে থাকে চেনা চৌহদ্দি, চেনা মানুষজনের পরিসরে। ক্ষমতার পরিসরে ‘কর্তার ভূত’ নানা অবয়বে, বিচিত্র পরিচয়ে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যক্তি এবং দণ্ডমুণ্ডের অধিকার। সুকুমারের আজগুবি কবিতায় থেকে যাচ্ছে এরই একরকমের চিরন্তন বয়ান। যেখানে শাসক যা ইচ্ছে করতে পারে, সেখানে যোগ দেয় শাসকঘনিষ্ঠরা, জনগণ রাজার বিধান অনুযায়ী সমস্ত অপমান হজম করে, আর সেই বাধ্যতাকে তারা অস্বীকার করলে ব্যবস্থা নেয় রাজার আইন। শৃঙ্খলা আর শৃঙ্খল যখন হামেশাই জুড়ে যায়, তখন বিশৃঙ্খলার উদ্ভটই হাতিয়ার। একদিকে ‘একুশে আইন’ বা ‘বোম্বাগড়ের রাজা’, আর অন্যদিকে ‘বিজ্ঞান শিক্ষা’ কিংবা ‘বুঝিয়ে বলা’। আলথুজার-এর রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস বা দমননীতি আর ইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস বা শিক্ষা-সংস্কৃতি-মতাদর্শের মধ্যে দিয়ে মগজ ধোলাই। পরবর্তী কালে সুকুমার-পুত্র যার নামকরণ করবেন মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র। আবোল তাবোল-এর লক্ষ্য বারবার, এক ক্ষমতাদর্পী একক স্বর। যে সর্বদা আধিপত্য ও কর্তৃত্বের ‘যুক্তি’ দিয়ে আচ্ছন্ন করে ফেলতে চায় ‘ছোট’-কে। সারা আবোল তাবোল জুড়ে রাজা-রানি সিপাই-সান্ত্রি-কোটাল নিয়ে রাজশক্তির প্রতি এত যে বিদ্রুপ ঝরে পড়ে, সে কি আজকের ভারতবর্ষের শ্বাসরোধী শাসনের নিরিখে প্রযোজ্য নয়? গাড়ুর নাম পরমকল্যাণবরেষু আর ছাতার নাম প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব নিয়ে হ য ব র ল যে হাসিতে ফেটে পড়ে, আজকের দিনে সেই অকিঞ্চিৎকর নাম বদলই হয়ে উঠেছে ক্ষমতার কার্যক্রম। যা-ইচ্ছে-তাই করার জোর ক্ষমতাকে যে অতিকায় রূপ দেয়, সুকুমারের হাতে সেটাই কৌতুকের, ব্যঙ্গের বস্তু। কারণ ক্ষমতাকে যদি ভাঙতে হয়, তা হলে ক্ষমতার ভয় ভাঙতে হবে, আর ক্ষমতার ভয় ভাঙতে হলে ক্ষমতাকে ব্যঙ্গ করতে পারা, তাকে নিয়ে হাসতে পারাই আম মানুষের হাতিয়ার।
‘ওগো রাজা মুখটি খোলো, কও না ইহার কারণ কী?’- হাসির আড়ালে উপনিবেশের রাজাকে এ প্রশ্ন করেছিলেন সুকুমার রায়। আজকের মণিপুর থেকে কলকাতা, সে প্রশ্ন কিন্তু জীবন্তই রয়েছে। অতএব সুকুমার রায়কে মনে না রেখে আমরা করব কী?