শিক্ষক আসলে একজন আশ্চর্য ডানার মানুষ। যে ডানা উড়াল দেয় স্বপ্নের দিকে। আর সেই ডানায় সওয়ার হতে পারে আরও অনেক মানুষ। নিজের দেখা এমনই এক আশ্চর্য শিক্ষকের কথা জানিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ।
পেশাগতভাবে শিক্ষাদানকে বেছে নেন অনেক মানুষ। কিন্তু তাঁদের মধ্যে, কিংবা তাঁদের বাইরেও এমন কেউ কেউ থেকে যান, যাঁদের সমগ্র জীবনটাই যেন অন্যদের কাছে হয়ে ওঠে এক পাঠ। যে পাঠে ছড়িয়ে যায় অন্যরকম এক আলো। আগামী জীবন যে আলোতে পথ দেখতে পায়। তেমনই একজন মানুষের কথা জানিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ। সেই মানুষটি প্রথাগতভাবে তাঁর শিক্ষক নন অবশ্য। পেশায় শিক্ষক এই মানুষটির লেখা বই তিনি স্কুলজীবনে পড়েছেন, আবার সহকর্মী হিসেবে কলেজে কিছুদিন পড়িয়েছেন একইসঙ্গে। আর সেই কলেজের সূত্রেই শোনা এক ঘটনা আলোর মতোই বরাবর জেগে ছিল তাঁর মনে। প্রবল চাওয়া-পাওয়ার হিসেবনিকেশের ভিড়ে সেই ঘটনা পাঠ দিতে পারে যে কাউকেই।
আরও শুনুন:
‘দিনের পর দিন মিছিলেই তো ছিলাম’, ক্ষুব্ধ সময়ে পথ চেনার হদিশ দিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ
শঙ্খ ঘোষ যাঁর কথা বলেছিলেন, তিনি রেজাউল করীম। বহরমপুরের মেয়েদের ওই কলেজের যখন সূচনা হয়, সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই সেখানে পড়াচ্ছিলেন তিনি। তখন সবাইকেই কাজ শুরু করতে হয়েছিল ৭০-৭৫ টাকায়। দেখতে দেখতে দিন গড়িয়েছে। ১৯৫৬ সাল নাগাদ হঠাৎ একদিন খাতাপত্র দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে, সবারই বেতন বেশ খানিকটা বেড়েছে, একমাত্র করীম সাহেব ছাড়া। কী করে এমনটা ঘটল তা নিয়ে কথা চালাচালি হল, এবং তড়িঘড়ি মীমাংসাও হল এ অসংগতির। এরপর একদিন কলেজের সভাপতি করীম সাহেবের সঙ্গে একান্ত কথাবার্তায় ফের এ ঘটনার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন। সে প্রসঙ্গেই সভাপতি বলেন, ‘কলেজের যে এত বড়ো একটা ভুল হচ্ছিল, সেটা খুব অন্যায়। কিন্তু আপনিও অন্যায় করেছেন খুব। এতদিন ধরে টাকা পাচ্ছেন না আপনি, বছরের পর বছর অন্যায় হচ্ছে আপনার ওপর, সেটা তো আপনি একবার বলবেন কাউকে? অন্তত আমাকেও তো বলতে পারতেন কখনো?’
এরপর কী ঘটেছিল, তা লিখছেন শঙ্খ ঘোষ। ‘এখন সব অলীক’ বই থেকে শুনে নেওয়া যাক সে অংশটুকু-
শুনে, খুব অপ্রস্তুত মুখে বলতে থাকেন করীম সাহেব: ‘আরে ছি-ছি, না-না, এতে কী হয়েছে। আমার তো তেমন কোনো অসুবিধে হচ্ছিল না কিছু। আমার আর কতটুকু কী লাগে বলুন। না-না, সে কিছু না। অবশ্য, একটা-দুটো সময়ে যে একটু মনখারাপ লাগত না তা নয়। আমার ভাগনিটা যখন এম. এ. পড়ত কলকাতায় গিয়ে, মাঝে মাঝে বই কিনতে চাইত। মোটা মোটা দামি বই তো সেসব। কিনে দিতে পারতাম না সেটা। তখন একটু মনখারাপ লাগত ঠিকই। কিন্তু ও তো এখন পাশ করে গেছে, আর তো এখন কোনোই অসুবিধে নেই আমার-‘
করীম সাহেবের এই সহজ উত্তরটুকু শুনিয়ে শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, “তাঁর মুখের ওই ‘আমার তো তেমন কোনো অসুবিধে হচ্ছিল না’ শুনে যে-কারো মনে হতে পারত, আমাদের দেশের বুনো রামনাথের কথাটা তাহলে নিছক গল্পকথা নয়, ব্যক্তিগত প্রত্যাশাহীন এমন বিভোর মানুষের দেখা পাওয়া আজও তবে সম্ভব, এই দেশেই; বহরমপুরে গোরা-বাজারের ছোট্ট একটা বাড়িতে এখনও দেখতে পাওয়া যায় এ রকম একজন মানুষ।”
ব্যক্তিক সব অসুবিধেকে গুরুত্ব না দিয়ে সমষ্টির অসুবিধের কথাই তো জীবনভর ভেবেছিলেন এই মানুষটি। তাঁর সেই জীবনবোধই যে কোনোরকম আত্মকেন্দ্রিকতার সামনে পথপ্রদর্শক হয়ে দাঁড়াতে পারে। শঙ্খ ঘোষ জানান, “বীরভূমের একটা গাঁয়ের পাঠশালা থেকে কলকাতার মাদ্রাসায় পড়া এই মানুষটি সেন্ট জেভিয়ার্সে ইন্টারমিডিয়েট পড়তে পড়তেই কলেজ ছেড়েছিলেন গান্ধিজির ডাকে, ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন অসহযোগ; পরে কখনো বিড়ির দোকানে হিসেব-নিকেশের কাজ করেছেন, কখনো-বা কোনো মসজিদে; রাজনীতি আর সাহিত্যের চর্চা করতে করতে বত্রিশ বছর বয়সে পাশ করেছেন এম. এ., বিনে পয়সার ছাত্রছাত্রীদের পড়িয়ে গেছেন তাঁর শাদাসিধে ঘরে; তাঁর আর অসুবিধে কোথায়! ব্যক্তিজীবনে কিছুমাত্র চাহিদা নেই তাঁর, ক্ষোভ নেই তাঁর, অল্প বয়সেই হারিয়েছেন স্ত্রী আর সন্তানদের, স্বপ্ন দেখেছেন শুধু সুস্থ আর সুন্দর এক সম্প্রদায়-বোধহীন ভারতবর্ষের”।
সত্যিই, সংস্কৃতি-সমন্বয়ের অগ্রদূত বলেই চিনে নেওয়া যেত রেজাউল করীমকে। যা কিছু তিনি লিখেছেন, সেই সমস্ত লেখা দাঁড়িয়ে ছিল হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ের ভাবনাকে অবলম্বন করে। শুধু লেখাই নয়, তাঁর গোটা জীবনটাও সেই একই বিশ্বাসে ভর করেই বেঁচে ছিল। ছেচল্লিশের কলকাতায় আহত হয়ে সারাজীবন তাঁকে চলতে হয়েছে লাঠি হাতে, তবুও তার আগে কিংবা পরে মানবতার স্বপ্নই দেখেছেন তিনি, আর সেই স্বপ্নের কথাই নানাভাবে নানা পথে বলে গিয়েছেন। যে সময়ে দাঁড়িয়ে মানবতাই বিভিন্নভাবে সংকটের মুখে পড়ছে, সেই দহনবেলায় এই পাঠ আমাদের ফের শিক্ষা দিতে পারে বইকি।