মেয়েদের রাগ, ক্ষোভ, বিক্ষোভ রাতের অন্ধকারকেই বেছে নিয়েছিল আলোর পথযাত্রায়। মেয়েদের রাত দখলের সেই মুহূর্ত তাই সময়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন। এই যে মেয়েদের রাগত প্রতিবাদ, তা কিন্তু অকস্মাৎ নয়। মৃদু স্বরে হলেও পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিরোধের জায়গাটি বজায় ছিল। যার সাক্ষ্য দেয় মূলস্রোতের হিন্দি সিনেমাও। দেখা যাবে, রাগী পুরুষের পাশাপাশি, সিনেমা কিন্তু রাগী মহিলাদেরও নির্মাণ করেছে।
মেয়েরা ক্রুদ্ধ। মেয়েরা প্রতিবাদী। মেয়েরা সোচ্চারে দখল করে নিতে চায় তাঁদের রাত। যে-রাত পিতৃতন্ত্রের চেনা ছক তাঁদের থেকে কেড়ে নিয়েছে। যে-রাত তাঁদের দিকেই ছুড়ে দিয়েছে অজস্র প্রশ্ন। দাঁড় করিয়েছে ভিক্টিম ব্লেমিং-এর চৌকাঠে। সেই রাতকেই নিজেদের শর্তে, নিজেদের মতো করে পেতে চেয়েছিলেন তাঁরা। নিহিত সেই বার্তা নিয়ে তাঁদের যে আন্দোলনের সাক্ষী থাকছে মহানগর, তা নিঃসন্দেহে অন্যরকম এক বাস্তবতা। এই অভিযান তো শুধু মেয়েদের নয়। এই অভিযান সামগ্রিক ভাবে এই সমাজেরই। যে-সমাজ নিজের অক্ষমতা ঢাকতে পদে পদে ছোট ছোট নিষেধের ডোরে বেঁধে রাখতে চায় মেয়েদের। সেই সমাজ তো নিজের খোলা দরজা-জানলাগুলোই বন্ধ করে রাখতে চায়। প্রগতিশীলতার দুয়ারে খিল দিয়ে ফেলে জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে। সেই সমাজের স্বার্থেই মেয়েরা হয়েছে প্রতিবাদী। তাঁদের রাগ, ক্ষোভ, বিক্ষোভ রাতের অন্ধকারকেই বেছে নিয়েছিল আলোর পথযাত্রায়। মেয়েদের রাত দখলের সেই মুহূর্ত তাই সময়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকচিহ্ন।
আরও শুনুন:
যৌনকর্মী, কিন্তু ‘ভালো মেয়ে’! দর্শকের খিদে মেটাতে যে পথে হেঁটেছে বলিউড
এই যে মেয়েদের রাগত প্রতিবাদ, তা কিন্তু অকস্মাৎ নয়। মৃদু স্বরে হলেও পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁদের প্রতিরোধের জায়গাটি বজায় ছিল। যার সাক্ষ্য দেয় মূলস্রোতের হিন্দি সিনেমাও। গবেষকরা বলে থাকেন, নিছক বিনোদনের খাতিরে বানানো হলেও, এই সব সিনেমার পরতে পরতে মিশে থাকে নানারকম সামাজিক বয়ান। দর্শক যে বৃহত্তর সমাজের অংশ, সিনেমা তো তার বাইরের কিছু নয়। ঠিক এই জায়গা থেকেই সাতের দশকে আবির্ভাব হয়েছিল অ্যাাংরি ইয়াং মেন-এর। সিনেমা থেকে সিনেমায় যে ভূমিকায় অদ্বিতীয় হয়ে উঠলেন অমিতাভ বচ্চন। নেপথ্যের কারিগর অবশ্যই সেলিম-জাভেদ জুটি। তাঁদের কল্পনাই চিত্রনাট্য হয়ে সময়ের আখর রচনা করেছিল। ফলত স্বাধীনতার দু-দশক পেরোনো দেশ, নানা যন্ত্রণায় বিদ্ধ হতে হতে খুঁজে নিতে চেয়েছিল এমন একজন নায়ককে, যিনি ক্রুদ্ধ। যিনি মানুষের স্বার্থে ছিনিয়ে আনতে পারেন প্রতিকার। জোগাতে পারেন লড়াইয়ের বারুদ।
ঠিক সেইখানেই থাকে আর-এক অভিযোগ। অনেকেই বলে থাকেন, সিনেমা যখন পুরুষকে অর্থাৎ নায়ককে এমন করে গড়ে তুলল, তখন নায়িকাকে সেভাবে প্রশ্রয় দিল কই! বহু কাল্ট সিনেমাতেই তাই নায়িকার ভূমিকা নায়ককে সমর্থনের। আবার নায়িকা বিপদে পড়লে, তাঁর রক্ষাকর্তা হয়ে বাড়তি গরিমা ও হাততালি কুড়িয়ে নিইয়ে যান নায়ক। মূলস্রোতের সিনেমার এ যে বেশ চেনা ছক, তা নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই। তবে সেই চেনা কাঠামোর ভিতরই অন্যধারার একটি স্রোত কিন্তু থেকেই গিয়েছিল। যেখানে দর্শক পেয়েছে ‘অ্যাংরি ইয়াং উইমেন’-কে।
‘খুন ভরি মাংগ’ সিনেমার রেখার কথাই ধরা যাক। রেখার কেরিয়ারের উল্লেখযোগ্য সিনেমা সেটি। সিনেমার গল্প ছিল এমনই, সেখানে যিনি অভিনেত্রী তিনিই কাহিনির নায়ক। নায়ক-নায়িকার চেনা ছিক সেখানে ভেঙেছিল অনেকটাই। গল্প অনুযায়ী, ছবির ক্লাইম্যাক্সে প্রতিশোধ নিতে দেখা গিয়েছিল রাগী রেখাকে। বা, ‘সীতা অউর গীতা’ ছবির হেমামালিনীর কথা আমরা মনে করতে পারি। দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। সেখানেও একজন নারী নানা অবিচারের শিকার। অন্যজন প্রতিবাদী। সমাজের দুরকম বাস্তবতাই যেন সেই দুই চরিত্রের মধ্যে ধরা পড়েছিল। কিরণ মেহতার ‘মির্চ মশালা’ ছবিতে স্মিতা পাতিলকে দেখা গিয়েছিল মেয়েদের সংঘবদ্ধ করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ভূমিকায়। দর্শকের মনে পড়তে পারে, বেশ কিছুদিন পরের সিনেমা ‘গুলাব গ্যাং’। মাধুরী দীক্ষিত এবং জুহি চাওলা সেই প্রথম একসঙ্গে এসেছিলেন স্ক্রিনে। মেয়েদের নির্যাতনের প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাহিনি নিয়েই তৈরি হয়েছিল সিনেমাটি। এরকম বহু উদাহরণই আছে। কখনও এই প্রতিবাদ-প্রতিরোধ এসেছে ব্যক্তিগত স্তরেও। যেমন, বিদ্যা বালান অভিনীত ‘কহানি’। তবে, ব্যক্তির স্তর অতিক্রম করে তা সামাজিক দুর্নীতিচক্রেরই পর্দাফাঁস করেছিল। ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’ ছবিতে জুটি বেঁধেছিলেন বিদ্যা বালন এবং রানি মুখোপাধ্যায়। সে-ছবিও তুলে ধরেছিল নারীর ক্রোধ এবং লড়াইকে। এই স্রোত কিন্তু বইছিলই। ফিলহালের ‘রকি অউর রানি কি প্রেম কাহানি’র মতো সিনেমাতেও আলিয়া ভাটের চরিত্রটিকে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা যায়। উল্লেখ করার মতো বিষয় হল, সে পিতৃতন্ত্রের ধারক যে শুধু পুরুষ নন, ছিলেন এক মহিলাও। এই দিকটাও উঠে আসে বিনোদনের মোড়কে। কিছুদিন আগের ওয়েব সিরিজ ‘দহড়’-এ পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় দেখা গেল সোনাক্ষী সিনহাকে। হতে পারে তিনি পুলিশের নির্ধারিত ভূমিকাই পালন করেছেন, সেই সঙ্গে একজন স্বনির্ভর এবং দলিত মহিলা হিসাবে তাঁর যে লড়াই এবং চোখ রাঙানিকে পরোয়া না-করা, তা সময়ের চিহ্ন হিসাবেই থেকে গিয়েছে।
আরও শুনুন:
অতি দেশপ্রেমের কবল থেকে কি এবার মুক্তি পাবে মেনস্ট্রিম সিনেমা?
এরকম বহু উদাহরণই দর্শকের মনে গেঁথে আছে। একটু মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, রাগী পুরুষের পাশপাশি, সিনেমা কিন্তু রাগী মহিলাদেরও নির্মাণ করেছে। অর্থাৎ সমাজের ভিতর বৈষম্য যে মহিলাদের ক্রুদ্ধ করেছে, সে বাস্তবতা একেবারে চাপা থাকেনি। মেয়েদের জমে ওঠা রাগেরই বিস্ফোরণ জাগরণের আন্দোলনে। তার ছোট ছোট চিহ্ন রাখা ছিল এই সমাজেই। অন্তত সিনেমা আমাদের সেই কথাটুকু বেশ ভালোভাবেই মনে করিয়ে দেয়।