কোনও রোম্যান্টিক অনুষঙ্গের সঙ্গে জুড়ে নেই এ প্রশ্ন। বরং ঠিক উলটো। এ প্রশ্নে জুড়ে আছে নারীর উপর পুরুষের তীব্র হিংস্র আধিপত্য বিস্তারের বয়ান। নারীত্বে পৌঁছনোর আগেই, নেহাত বালিকা বয়সেও পুরুষের লোভের থাবা এগিয়ে আসে মেয়েদের শরীরের দিকে।
হাউ ওল্ড ওয়্যার ইউ?
তখন তোমার বয়স কত ছিল?
শুনলে মনে পড়তে পারে সেই প্রেমের গানটি, তখন তোমার একুশ বছর বোধহয়…। কিন্তু না। কোনও রোম্যান্টিক অনুষঙ্গের সঙ্গে জুড়ে নেই এ প্রশ্ন। বরং ঠিক উলটো। এ প্রশ্নে জুড়ে আছে নারীর উপর পুরুষের তীব্র হিংস্র আধিপত্য বিস্তারের বয়ান। নারীত্বে পৌঁছনোর আগেই, নেহাত বালিকা বয়সেও পুরুষের লোভের থাবা এগিয়ে আসে মেয়েদের শরীরের দিকে। বাবার বন্ধু, বন্ধুর বাবা, গৃহশিক্ষক, পরিচারক, চেনা অচেনা যে কোনও পুরুষ,- যে কারও আদিম প্রবৃত্তির শিকার হতে পারে কোনও খুদে। ভালোবাসা আর ভালোবেসে শরীর ছোঁয়া ঠিক কেমন, তা জানার আগেই শরীরের সঙ্গে এক ঘিনঘিনে অনুভূতি জুড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা পায় সে। সম্প্রতি আর জি কর হাসপাতালে কর্মরতা চিকিৎসক তরুণীর ধর্ষণ খুন নিয়ে যখন গোটা দেশ তোলপাড়, মেয়েদের ঘরে-বাইরে কোত্থাও সুরক্ষা না পাওয়ার ছবিটি যখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, সেই সময়েই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন উঠছে, হাউ ওল্ড ওয়্যার ইউ? অর্থাৎ, প্রথমবার হেনস্তার শিকার হওয়ার সময় বয়স কত ছিল?
আরও শুনুন:
কাঁদছেন মা দুর্গা, তবু বধ তিন অসুরকে… খুদে শিল্পীর ভাবনা ভাবাচ্ছে সময়কে
এ প্রশ্ন আর তার উত্তর, দুই-ই যে কোনও সংবেদনশীল মানুষকে হাড় হিম করা ভয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে। আজকের তরুণী, যুবতি, পূর্ণ নারী হয়ে ওঠা মহিলারা মনে করছেন, কেউ বছর পাঁচেক বয়সে প্রথমবার এই কুৎসিত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলেন। কারও সাত, কারও নয়, কারও বারো, চোদ্দো, পনেরো… মনে হবে, সত্যিই, বয়স এখানে একটা সংখ্যা মাত্র। লালসার কাছে জরুরি নয়, কার কত বয়স তা হিসেব করা। লালসা কেবল একটা শরীর চায়, তার জিভ-দাঁতের সদ্ব্যবহার করার জন্য।
মনে পড়ে ২০১৮ সালের সেই জানুয়ারি মাসের কথা। কাঠুয়ার বাসিন্দা আসিফা বানো একাধিক লোকের লালসায় ঝলসে গিয়েছিল। তার বয়স তখন বছর আট। নৃশংস সেই ঘটনা আমাদের যখন স্তব্ধ করে দিচ্ছে, সেই সময়েই ভাইরাল হয়েছিল একটি স্ক্রিনশট। যেখানে দেখা যাচ্ছিল একটি পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইটে সার্চের শীর্ষে চোখ ঝলসে দিচ্ছে একটি ছোট্ট নাম, আসিফা।
আসিফা যে একা নয়, আসিফা যে যে-কেউ হতে পারত, যে-কোনও বাচ্চা মেয়ের পরিণতি হতে পারে আসিফার মতো- এই স্ক্রিনশটটিই সে কথা বুঝিয়ে দিতে যথেষ্ট। ক্রাই (চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ) সংস্থার পরিসংখ্যান বলে, প্রতি পনেরো মিনিটে একটি শিশু নির্যাতিত হচ্ছে, সেই শিশু যার মধ্যে আপনার মেয়ে বা ছেলেও থাকতে পারে। ভারতে অর্ধেকের বেশি নাবালিকা যৌন নির্যাতনের শিকার। সে কাঠুয়ার আট বছরের মেয়ে আসিফা হোক, কি ইন্দোরের আট মাসের শিশুকন্যাটি। অতিমারির ফলে চলা লকডাউনে ভারতে শিশু পর্নোগ্রাফি সামগ্রীর ব্যবহার বেড়েছিল ৯৫ শতাংশ। সে সময়েই ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড এক্সপ্লয়েটেড চিলড্রেন’-এর পরিসংখ্যান জানিয়েছিল, বিভিন্ন নেটমাধ্যমে সন্দেহভাজন প্রায় ২৫ হাজার শিশু পর্নোগ্রাফি আপলোড করা হয়েছে। রাজ্যভিত্তিক সম্পূর্ণ তালিকা না পাওয়া গেলেও ওই তালিকার শীর্ষে আছে দিল্লি। তার পরেই মহারাষ্ট্র, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য।
আরও শুনুন:
দল বা কোন্দল নয়, ভয় না পাওয়াই রাজনৈতিক
মনে পড়ে আত্মজীবনী ‘সাচ কহুঁ তো’ বইয়ে নীনা গুপ্তা লিখেছিলেন এক দর্জি আর এক ডাক্তারের কথা। পেশা আলাদা, কিন্তু স্কুলের ছাত্রী নীনার কাছে এই দুজনের পরিচয়ই এক ছিল। সে পরিচয় নির্যাতকের। ‘ওপেন বুক: নট কোয়াইট আ মেমোয়্যার’ বইয়ে কুবরা সইত লেখেন, টানা আড়াই বছর ধরে তাঁকে নিয়মিত যৌন হেনস্তার বিষাক্ত অভিজ্ঞতা উপহার দিয়েছিলেন তাঁর মায়ের এক উপকারী বন্ধু। বিবাহিত সেই পুরুষের লালসার কাছে গুটিয়ে থাকতে হত বছর সতেরোর মেয়েটিকে। অধিকাংশ মেয়েরাই এই অনুভূতি চেনেন, কোনও না কোনও ভাবে। রাস্তাঘাটে উড়ে আসা যৌনগন্ধী মন্তব্য, ট্রেনে বাসে শরীরে ঘুরে বেড়ানো হাত, কোনও আত্মীয়ের থাবা- মেয়েবেলা থেকে চেনা এইসব গা-ঘিনঘিনে ঘটনা। হাউ ওল্ড ওয়্যার ইউ?- এ প্রশ্নটা তাই বড্ড সহজ। আর তার উত্তরও তো জানাই।