‘মার’ খেতে হয়েছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও। তবে, সেই মারের সাগর অতিক্রম করার সাহস যে মানুষেরই আছে, সেই বিশ্বাসের কথাও তো তিনিই বলেছেন। সুতরাং যে কোনও জরুরি অবস্থার সময় ভয় এসে আমাদের জাপটে ধরে। তবে, সেই ভয় কেটে বেরোনোই সবথেকে জরুরি।
‘বাসের হাতল কেউ দ্রুত পায়ে ছুঁতে এলে/ আগে তাকে প্রশ্ন করো তুমি কোন্ দলে’ – কবি শঙ্খ ঘোষের এ-পঙক্তি যেন আজ ভিন্নভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। নারকীয় এক ঘটনার প্রতিবাদে প্রতিবাদে গোটা রাজ্য যখন উত্তাল, তখনও সেই একই প্রশ্ন, তুমি কোন দলে? নাকি দলে নেই? তাই নিয়ে দেদার কোন্দল। তবে সেই সব কথার ভিতর যেটা স্পষ্ট তা হল, ভয় কেটে বেরিয়ে আসা। ক্ষমতা তার স্বভাবগুণেই প্রার্থনা করে আনুগত্য। আর সেখানে তার সবথেকে বড় হাতিয়ার- ভয়। দল হোক বা দলহীন ভাবে, মানুষ যখন দলবদ্ধ হয়ে এই ভয়ের তর্জনী উপেক্ষা করে, তখন সেই উপেক্ষাই যেন হয়ে ওঠে সবথেকে বড় রাজনৈতিক চিহ্ন।
এই ভয় অতিক্রম করার কথাই বলেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, তাঁর নিজের জীবনের ঘটনার প্রেক্ষিতেই। তখন জরুরি অবস্থা চলছে। শোনা গেল, এক বিখ্যাত সাহিত্যপত্রিকায় তাঁর দুটি কবিতা ছাপা যাবে না। প্রথমে ছিল গুজব। কবি নিজেই সম্পাদককে ফোন করে জানলেন, গুজব নয়, ঘটনা সত্যি। সম্পাদক অনুরোধ করলেন, আরও দুটি কবিতা যেন তিনি লিখে দেন। কিন্তু কবি বললেন, এখন যে কবিতাই দেওয়া হোক না কেন, তার ক্ষেত্রে একই দাবি উঠবে। বরং যদি কোনও সম্পাদক সরকারি দপ্তরে জমা না দিয়ে কবিতা ছাপার প্রতিশ্রুতি দেন, তাঁকে কবিতা দিতে পারেন। উল্লেখ করার মতো বিষয় হল, সরকারি কোপে পড়া কবিতা দুটিও প্রকাশিত হয়েছিল। তা প্রকাশ করেছিলেন অরুণ সেন এবং বার্ণিক রায়। কবিতা দুটির একটি ছিল ‘রাধাচূড়া’, অন্যটি ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’। এই ঘটনার উল্লেখ করেই শঙ্খবাবু বলেছিলেন, ‘একটা কথা বলি এখানে কবিতাদুটো ছাপিয়ে কিন্তু অরুণ বা বার্ণিকের কোনও সমস্যা হয়নি, আমারও না। জরুরি অবস্থায় যেটা সবচেয়ে বেশি করে সবাইকে জাপটে ধরেছিল তা হলো ভয়। অনেকসময়ই অহেতুক, অনির্দেশ্য ভয়।’ (সূত্র: কথার পিঠে কথা)
আরও শুনুন: কাঁদছেন মা দুর্গা, তবু বধ তিন অসুরকে… খুদে শিল্পীর ভাবনা ভাবাচ্ছে সময়কে
তবে সেই ভয় যে নীরবেই পেরিয়ে যাওয়া যায়, তাও তো কবির কাজেই প্রমাণ। রক্তকরবীর রাজা নন্দিনীর কাছে জানতে চেয়েছিল, যক্ষপুরীকে সে ভয় পাচ্ছে কি-না! নন্দিনী যে ভয় পায়নি, সে তো আমরা জানিই। নন্দিনীর স্রষ্টাও এরকম পরিস্থিতিতে ভয় পাননি। তাও আমাদের কাছে উদাহরণের মতোই। এই দুর্দিনে তা স্মরণ করা বোধহয় অমূলক হবে না।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তাঁর নাইট উপাধি ত্যাগের কথা সকলেরই জানা। সারা ভারত যখন প্রায় নীরব, তখন একাই সরব হয়েছিলেন কবি। রাজনৈতিক ভাবে কিছু করে ওঠার ক্ষেত্রে যখন নানারকম বাধ্যবাধকতা, তখন তিনি নিজেই পদক্ষেপ করেছিলেন। এমনকী সে সময় সংবাদপত্রে এ-ও লেখা হয়েছিল যে, কবি বড় ঝুঁকি নিয়েছেন। তখন রাওলাট আইন পাশ হয়ে গেছে। ফলত রাজার প্রতি অসম্মানের কারণ দর্শিয়ে তাঁকে গ্রেপ্তার বা শাস্তি দেওয়া অসম্ভব ছিল না। কবি নিজেও সে-কথা জানতেন। সেই সময় রাণুকে যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে ঠাট্টা করেই এই ইঙ্গিত দিয়েও রেখেছিলেন। তবে, সেই ভয়ে তিনি তাঁর কর্তব্য থেকে বিরত হননি। নানা সমালোচনা মাথা পেতে নিয়েছিলেন। পরে অমিয় চক্রবর্তীকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন, ‘আমাদের কত যে দুঃখ কত যে দায়িত্ব তার সীমা নেই- অথচ আমরা কেবল দুঃখটাকেই বহন করে চলেছি দায়িত্বকে গ্রহণ করচি নে এইটেতেই আমরা কেবল নেবে যাচ্চি। সকল বড় বড় দেশেই এমন সকল বীর আছে যারা দুর্গতিকে চরম বলে কিছুতেই স্বীকার করে না- যারা নিজের প্রাণ দিয়েও তাকে উপহাস করে। আমরা আলস্য ঔদাস্য বশত দুর্গতির সঙ্গে আপষে সন্ধি করে বসে আছি- এমন কি, তার পক্ষসমর্থন করে তার প্রশংসা করে তার বলবৃদ্ধি করচি। সেইজন্যে এতদিন আমি বড় দুঃখ পাচ্ছিলুম যে, আমাদের যুবকেরাও এই ভীরুতা এই কপটতাকেও আত্মশ্লাঘায় পরিণত করে আস্ফালন করে বেড়াচ্চে। এতদিন এই নিয়ে কেবলই লড়াই করেছি এবং দেশের লোকের কাছ থেকে নিয়ত মার খেয়েচি।’
হ্যাঁ, মার খেতে হয়েছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেও। তবে, সেই মারের সাগর অতিক্রম করার সাহস যে মানুষেরই আছে, সেই বিশ্বাসের কথাও তো তিনিই বলেছেন। সুতরাং যে কোনও জরুরি অবস্থার সময় ভয় এসে আমাদের জাপটে ধরে। তবে, সেই ভয় কেটে বেরোনোই সবথেকে জরুরি।