আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে উত্তাল বাংলা। বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়েছে গোটা দেশেই। এর মাঝে কলকাতা ডার্বি বাতিল নতুন করে ঘি ঢেলেছে। তিন প্রধানের সমর্থকরা একজোট হয়ে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন। ময়দানে এমনই এক প্রতিবাদ দেখিয়েছিলেন গোষ্ঠ পাল। ঠিক কোন ঘটনার কথা বলছি? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
গোষ্ঠ পাল। ভারতীয় ফুটবলের ‘দ্য চাইনিজ ওয়াল’। শুধু কিংবদন্তি খেলোয়াড় হিসেবে নয়। তাঁকে মনে রাখার হাজার একটা কারণ রয়েছে। সেই তালিকায় গোষ্ঠ পালের প্রতিবাদী সত্ত্বা হয়তো সবার উপরে থাকবে। যে সমাজে খেলাধুলো করাটাই লড়াইয়ে চাইতে কম ছিল না, সেখানে ব্রিটিশদের চোখে চোখ রেখে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন গোষ্ঠ পাল।
এসপ্ল্যানেড থেকে ময়দানের দিকে এগোলেই, গোষ্ঠ পালের বড় একটা মূর্তি চোখে পড়ে। খালি পা। তার সঙ্গে জুড়ে ফুটবল। যেন খেলার মাঠ থেকে জীবন্ত উঠে এসেছেন। ফুটবলপ্রেমীরা তো বটেই, সাধারণ মানুষের কাছেও গোষ্ঠ পালের নাম অচেনা নয়। ছোট থেকেই ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব। তাই ইংরেজদের দেওয়া ‘চৌধুরী’ পদবি কখনও ব্যবহার করেননি। ফুটবল ভালোবাসতেন পাগলের মতো। গ্রামের ছেলে, মাঠে ঘাটে কাদা মেখে খেলাধুলো করাই ছিল অভ্যেস। তবে গোষ্ঠ যে অন্যদের মতো নন, তা সকলেই বেশ টের পেতেন। হাতে কলমে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিলেন ১১ বছর বয়সে। গ্রাম ছেড়ে কলকাতার একটা ক্লাবে খেলা শুরু করলেন গোষ্ঠ। এরই মধ্যে আই এফ এ শিল্ড জিতেছে মোহনবাগান। কলকাতা সহ গোটা দেশ জুড়েই ছড়াল ফুটবলের নাম। ধীরে ধীরে নাগরিকতার সোপান হয়ে উঠল এই খেলা। তার সঙ্গে স্বদেশি আন্দোলন জুড়তেও বেশি সময় যায়নি।
গোষ্ঠ তখন কুমোরটুলি ক্লাবের চেনামুখ। অবশ্য মুখের চাইতেও সকলের নজর কাড়ত তাঁর বিশাল চেহারা। একইসঙ্গে ছিল অসাধারণ ট্যাকল করার ক্ষমতা। ১৯১২ সালে গোষ্ঠ পাল যোগ দিলেন মোহনবাগানে। তারপর অবশ্য পিছন ফিরে দেখতে হয়নি। একের পর এক সাফল্য এনে ইতিহাস গড়েছেন গোষ্ঠ পাল। স্মারক হিসেবে এখনও মোহনবাগানের ক্লাব তাঁবুর রাস্তাটি তাঁর নামেই।
এই গোষ্ঠ পালের হাত ধরেই ময়দান সাক্ষী ছিল একাধিক প্রতিবাদের। স্বাধীন সংগ্রামীদের মতো পথে বিপ্লব তিনি করেননি। তবে তাঁর আচরণ, সাহেবদের ভালমতো বুঝিয়ে দিত তিনি কতটা ব্রিটিশ বিরোধী। ১৯৩৫ সালের মোহনবাগান বনাম ক্যালকাটা ক্লাব ম্যাচের কথাই ধরা যাক। একদিকে দুরন্ত গতির সাদা চামড়ার সাহেবদের দল। অন্যদিকে গোষ্ঠর মোহনবাগান। বুটজুতো বনাম খালি পায়ের লড়াই। তখনকার দিনেও মোহনবাগানের এই ধরনের ম্যাচ থাকলে, রীতিমতো ভিড় জমে যেত আশেপাশে। এদিনও ব্যতিক্রম হয়নি। একইসঙ্গে ছিল রেফারির পক্ষপাতিত্ব। এমনিতে সাহেবদের খেলায় রেফারিও সাদা চামড়ার কোনও সাহেবই হতেন। যে কোনও ম্যাচেই রেফারির সিদ্ধান্ত সাহেবদের পক্ষে যেত। এদিনের ম্যাচের শুরু থেকেই এমনটা করতে শুরু করেন রেফারি ক্লেইটন। প্রথমে কিছু না বললেও, একসময় সহ্যের সীমা ছাড়ায় অধিনায়ক গোষ্ঠ পালের। সতীর্থদের নির্দেশ দেন খেলা থামিয়ে মাঠের মধ্যে শুয়ে পড়তে। সঙ্গে সঙ্গে তেমনটা করলেন বাকি খেলোয়াড়রা। মাঝপথে খেলা থামাতে বাধ্য হলেন রেফারি। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এমন প্রতিবাদ হয়তো ভাবা যেতে পারে। কিন্তু সেইসময় এ জিনিস ভাবাও যেত না। অথচ গোষ্ঠ পাল করে দেখিয়েছিলেন। মাঠে দাঁড়িয়েই ব্রিটিশদের চোখে চোখ রেখে বুঝিয়েছিলেন, তিনি কাউকে ভয় পান না। এর জন্য অবশ্য শাস্তিও জুটেছিল। চিরকালের মতো ফুটবল ছাড়তে বাধ্য করা হয় মোহন অধিনায়ককে। কিন্তু সেদিন যে সাহস তিনি দেখিয়েছিলেন, তা ভাবতে বাধ্য করেছিল উঁচু মহলের ব্রিটিশ অধিকর্তাদেরও।
সেই বিদ্রোহের ছবিই যেন ফের ধরা পড়ল ফুটবল সমর্থকদের চেহারায়। কলকাতার তিন প্রধানের সমর্থকরা একজোট হয়ে বুঝিয়ে দিলেন, তাঁরা কাউকে ভয় পান না। আটক হলেন। পুলিশের গাড়িতে উঠলেন। সেখান থেকেও জোর গলায় দাবি তুললেন, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’! শাস্তি হিসেবে পুলিশের লাঠি তাঁরাও খেলেন। কিন্তু দমে গেলেন কি? একেবারেই না। বরং সমর্থকদের আন্দোলনের ঝাঁঝ সহ্য না করতে পেরে পিছু হটতে বাধ্য হল পুলিশ। সেই প্রতিবাদে শামিল হলেন মোহনবাগানের বর্তমান অধিনায়ক শুভাসিসও। দল-মত নির্বিশেষে ফুটবলের জয় ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন তাঁরা। জন্মদিনে এর থেকে ভালো উপহার আর কী ই পেতেন গোষ্ঠ পাল!