অন্যায়ের বিরুদ্ধে মিলিত প্রতিবাদই সুরক্ষিত করতে পারে নাগরিককে। বাঙালির ঘরে যত ভাই-বোন এ হয়ে যেন পথে পথে মুখরিত করে তুলেছে রাখিবন্ধনের সেই নিহিত বার্তাই।
নির্যাতনে নির্যাতনে নগর যখন নরক গুলজার, তখন রাখিবন্ধনের তিথি যেন নেহাতই মিথ। নাকি মিথ্যে! যে সকাল রাতের থেকেও অন্ধকার, সেখানে রাখির সুতোও যেন তলিয়ে যায় তমশায়।
অথচ কত মিথই তো মিশে আছে রাখির সুতোয়। পৌরাণিক কাহিনিতেও সে ছোঁয়া। স্বয়ং কৃষ্ণের নাকি একবার আঙুল কেটে গিয়েছিল। তখন দ্রৌপদী নিজের বস্ত্র দিয়ে ক্ষতস্থান বেঁধে দিয়েছিলেন। তারপর যেদিন কৌরবদের সভায় লাঞ্ছনার শিকার তিনি, সেদিন বস্ত্র দিয়েই তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন কৃষ্ণ। এই কাহিনিই নানা পরতে মিশে আছে অন্য অন্য গল্পেও। বদলে গিয়েছে চরিত্র। কোথাও তা হয়ে উঠেছে যম-যমীর উপাখ্যান। কখনও আবার ঐতিহাসিক ঘটনায় মিশে গিয়েছে রাখির প্রাচীন ঐতিহ্য। তবে, মোদ্দা কথা এই যে, রাখির বন্ধনের মধ্যে ভাই-বোনের পারস্পরিক সম্পর্কের জোরালো সূত্রটির কথাই উঠে আসে। মূলত তা লৌকিক আচার। সেখানে জোরের কথাটি হল, সুরক্ষা।
এই পৌরাণিক প্রসঙ্গ খানিকটা সরিয়ে রেখেই রাখিবন্ধন হয়ে উঠেছিল আধুনিক। যখন বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলনে রাখিকেই বন্ধনের সুতো করে তুললেন রবীন্দ্রনাথ। তা অবশ্য শুধু ভাই-বোনের সম্পর্কে আবদ্ধ থাকল না। বরং তা বৃহত্তর অর্থে চলে এসেছিল বাঙালির জীবনে। যা আজও প্রবহমান।
সময় বদলেছে। রাখির সঙ্গে বোনকে রক্ষার যে প্রতিশ্রুতি একদা জুড়ে ছিল, সেই ধারণাতেও বদল এসেছে অনেকখানি। সময়ের প্রেক্ষিতে তা স্বাভাবিকও। বরং বর্তমান পৃথিবীতে, রাখিবন্ধন এক সার্বজনীন উৎসব। তা দু’জন মানুষের বন্ধনও বটে! তবু পুরনো প্রসঙ্গ আজও খানিক জেগে আছে। রাখিপূর্ণিমার দিনে, এখনও ভাইয়ের হাতে রাখি পরান বোনেরা। যেন পরস্পর পরস্পরের বিপদে পাশে দাঁড়ায়! কোথাও যেন মিশে থাকে এই প্রতিশ্রুতি, এই ভরসার জায়গা। অথচ সময়ের যে বিপজ্জনক বাঁক, তাতে সুরক্ষার স্বপ্ন যেন অসার। মানচিত্র আলাদা করতে পারে না নির্যাতনের ছবি। লাঞ্ছনার সেই ইতিবৃত্তে আর কোথায় সুরক্ষার স্বপ্ন! প্রতিদিন হীন থেকে হীন ঘটনায় মানুষ এত ক্ষুদ্র, সংকুচিত, অসহায় হয়ে পড়ে যে পারস্পরিক ভরসার জায়গাটিই যেন টলে যায়। একজন ব্যক্তি আর একজন ব্যক্তিকে আর কতখানি সুরক্ষা দিতে পারে! সেখানে এসে পড়ে রাষ্ট্রব্যবস্থার ছায়া। আর তখনই যত গোলমাল। যা কিনা অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, তা একদিন তার জনগণকেই অবজ্ঞা করতে দ্বিধা করে না। এরকম বিবর্ণ দিনে সব গৌরব হারিয়ে রাখি যেন নেহাতই সুতোর পলকা বন্ধন।
তবু অন্ধকার থাকে বলেই তা কেটে যাওয়ার আশাও থাকে। সম্প্রতি, নারী নির্যাতনের ঘটনায় যেভাবে প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছে নগর, গড়ে উঠেছে মানববন্ধন, তাই-ই বোধহয় সম্মিলিত মানুষের রাখিবন্ধন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মিলিত প্রতিবাদই সুরক্ষিত করতে পারে নাগরিককে। বাঙালির ঘরে যত ভাই-বোন এ হয়ে যেন পথে পথে মুখরিত করে তুলেছে রাখিবন্ধনের সেই নিহিত বার্তাই।