আর জি কর হাসপাতালে চিকিৎসক তরুণীকে ধর্ষণ খুনের ঘটনায় তোলপাড় রাজ্য থেকে দেশ। এর আগেও একাধিকবার ধর্ষণ কাণ্ডের অভিঘাতে আলোড়ন উঠেছে দেশ। সেইসব ঘটনাকে ফের মনে পড়িয়ে দিচ্ছে আর জি কর কাণ্ড।
ধর্ষণের ঘটনা আসলে নতুন নয়। ধর্ষণের ঘটনা আসলে পুরনোও নয়। এক-একটি ঘটনা তার ভয়াবহতার জেরে আমাদের আপাত নিশ্চিন্তিকে আমূল নাড়িয়ে দেয়। ভেঙে যায় নির্বিরোধী ঘুম। আর জি করে ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনাটি তেমনই এক তীক্ষ্ণ শলাকার মতো। যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সারা দেশে মাথা উঁচিয়ে বেড়ানো ধর্ষণ সংস্কৃতিকে। এ ঘটনায় সওয়ার হয়ে এসেছে ফেলে আসা আরও একাধিক ঘটনার স্মৃতি, যা একইভাবে কখনও না কখনও আমাদের নিশ্চিন্তির পরিসরকে ছিঁড়েখুঁড়ে তছনছ করে দিয়েছিল।
আরও শুনুন:
কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্তার মুখোমুখি, ভারতীয় আইনে কীভাবে সুরক্ষা পেতে পারেন নারীরা?
হাসপাতালের মধ্যেই চিকিৎসককে ধর্ষণের ঘটনা প্রথমেই মনে করিয়ে দিয়েছে অরুণা শানবাগের কথা। ১৯৭৩-এর ২৭ নভেম্বর, হাসপাতালের ভিতরেই ধর্ষিতা হয়েছিলেন অরুণা রামচন্দ্র শানবাগ। তিনি যখন পোশাক বদলাচ্ছিলেন, তখনই আচমকা অরুণার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওয়ার্ড-বয় সোহনলাল ভরত বাল্মীকী। কুকুর বাঁধার চেন দিয়ে অরুণার গলা বেঁধে ফেলে তাঁকে ধর্ষণ করে সে। কোমায় চলে যান অরুণা। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত, টানা ৪২টা বছর, হাসপাতালের বেডে সেইভাবেই জীবন্মৃত হয়ে ‘বেঁচে’ ছিলেন অরুণা শানবাগ।
১৯৭৮ সালে গীতা চোপড়ার ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দিল্লিকে। গীতা ও গীতার ভাই সঞ্জয়কে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল যশবীর সিংহ ওরফে বিল্লা ও কুলজিৎ সিংহ ওরফে রাঙ্গা। ধর্ষণ করে খুন করা হয় তাঁকে, ভাইও রেহাই পাননি। ওই বছরেই মথুরার দেশাইগঞ্জ পুলিশ স্টেশনে এক আদিবাসী মহিলাকে ধর্ষণ করেছিল দুই পুলিশ কনস্টেবল। যদিও মামলার রায়ে দিব্যি রেহাই পেয়ে যায় তারা। সেই সময় এই রায়ের বিরুদ্ধে এবং ধর্ষণ আইনে পরিবর্তন আনার দাবিতে সারা দেশ বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছিল।
আরও শুনুন:
বাড়ছে ধর্ষণের হার, তুলনায় শাস্তি হচ্ছে কি! আর জি কর যে প্রশ্ন তুলল ফের
১৯৯০ সালে কলকাতার কিশোরী হেতাল পারেখের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা নিয়েও কম জলঘোলা হয়নি। ১৯৯৬ সালে দিল্লিতে নিজের ঘরেই ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল বছর পঁচিশের আইনের ছাত্রী প্রিয়দর্শিনীকে। ধর্ষক তাঁর সহপাঠী সন্তোষ কুমার সিং। ২০১২ সালে সেই রাজধানীর বুকেই নির্ভয়া ধর্ষণ কাণ্ড গোটা দেশকে কাঁপিয়ে দেয়। রাতের বাসে ফেরার সময় বাস ড্রাইভার সহ ছয় ব্যক্তি অমানুষিক নৃশংসতায় ধর্ষণ করে জ্যোতিকে। তাদের মধ্যে শামিল ছিল এক নাবালকও। ধর্ষক এবং তাদের আইনজীবীরা যেভাবে মেয়েটির রাতে বেরোনোর দিকে আঙুল তোলে ও ধর্ষণের সাফাই দেয়, তা দেশের সব মেয়েদেরই বিপন্ন করেছিল। সেই ২০১২-তেই কলকাতার বুকে পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষিতা হন সুজেট জর্ডন, যে ঘটনায় বারবার ধর্ষিতার দিকেই আঙুল তোলা হয়, এমনকি প্রশাসনের তরফেও।
ধর্ষণের সঙ্গে আসলে সবসময়েই জুড়ে যায় ক্ষমতার ভাষা। ২০০২ সালে গুজরাট যখন গোধরার পরে হিংসার আগুনে জ্বলছে, সেই সময় পালাতে গিয়ে গণধর্ষিতা হয়েছিলেন ২১ বছরের বিলকিস বানো। সে ঘটনার ভয়াবহতা নিয়ে এতদিন পরেও কথা হয়। এখনও তাঁর ধর্ষকদের মুক্তির সওয়াল চলে, আর বিলকিসকে পালিয়ে বেড়াতে হয়। ২০১৮ সালে কাঠুয়াকে আট বছরের আসিফা বানুকে ধর্ষণ করে খুনের পর ধর্ষকদের মুক্তির দাবিতেই গেরুয়া মিছিল বেরিয়েছিল। ২০২০ সালে হাথরাসে নারকীয় গণধর্ষণ ও খুনের পর তড়িঘড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ধর্ষিতার দেহ। গোটা ঘটনায় অপরাধীদের আড়াল করার বিষয়ে প্রশাসনের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। একই পরিস্থিতি দেখা যায় ২০১৭-তে উন্নাও গণধর্ষণ কাণ্ডের সময়েও। ২০১৯ সালে হায়দরাবাদে বাড়ি ফেরার পথে ধর্ষণ খুনের শিকার হন এক চিকিৎসক তরুণী। সেবারেও প্রমাণ লোপাট করতে দেহ পুড়িয়ে দিয়েছিল অপরাধীরা। ২০১৩-র কামদুনি ধর্ষণ কাণ্ডের নৃশংসতাও সকলকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
আরও শুনুন:
হাসপাতালে কি আদৌ নিরাপদ মহিলা কর্মীরা? আর.জি.কর মনে করাচ্ছে অরুণাকেও
না, নৃশংসতার তুলনা টানার জন্য একের পর এক ঘটনা বলা হচ্ছে না। এই সব ঘটনাই আসলে হিমশৈলের ওপরের চূড়া মাত্র। ২০২২ সালেও ন্যাশনাল ক্রাইম রিপোর্ট ব্যুরোর তথ্য জানিয়েছে, গড়ে প্রতিদিন ধর্ষণের শিকার হন দেশের ৯০ জন নারী। কিন্তু যতক্ষণ না ভয়াবহতার বিচারে ধর্ষণ কাণ্ড বড় না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তার থেকে আমরা চোখ ফিরিয়েই থাকি। যেভাবে রাস্তাঘাটে, বাড়িতে, কাজের জায়গায় যৌন হেনস্তা সয়ে নিই, তেমনই এসব খবরকেও আমরা সয়েই নিয়েছি। আর সেই কারণেই এই নিষ্ঠুরতার পুরনো বিবরণ নিজেদের মনে করানো জরুরি। মনে করানো জরুরি, এই দীর্ঘ নিষ্ঠুরতার তালিকাকে ভুলে যাওয়া, এবং আবার কোনও ভয়ংকর ধর্ষণের প্রেক্ষিতেই কেবল তা মনে পড়া, এও আসলে কম নিষ্ঠুরতা নয়।