নারীশিক্ষা নিয়ে বক্তৃতা দেবেন পুরুষেরা, আর নারীরা ব্যারিকেডের ওপাশে! ব্যারিকেড ভেঙে সেদিন মঞ্চ দখল করেছিলেন চন্দ্রপ্রভা। স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়েছিলেন এই নারী, আবার ঘরেও তিনি বিপ্লবী। স্বাধীনতার দিনে মনে করা যাক তাঁর কথা।
নেতার ভূমিকায় পুরুষ, আর মেয়েরা হাঁটবে পিছনে, এমনই ছবি তো দীর্ঘদিন ধরে দেখেছে সমাজ। এখনও সে ছবি পুরো বদলায়নি। পাশাপাশি এগোনোর বদলে নারী-পুরুষের মধ্যে জারি রয়ে গিয়েছে শ্রেণির ব্যবধান। কিন্তু সেই ব্যবধান ভাঙতেই চেয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী চন্দ্রপ্রভা। ঘরে বাইরে জারি রেখেছিলেন বিদ্রোহ। তাও সেই উনিশ শতকের পরাধীন দেশেই।
আরও শুনুন:
যৌনাঙ্গে লঙ্কাবাটা ঢুকিয়ে দেয় ব্রিটিশ পুলিশ, তবুও হার মানেননি প্রথম মহিলা রাজবন্দি ননীবালা
সেটা ১৯২৫ সাল। অসম সাহিত্য সভার আসর বসেছে নগাঁওয়ে। নারীশিক্ষার প্রসার ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে মঞ্চে ভাষণ দিচ্ছেন সভাপতি। মেয়েদের শিক্ষা নিয়েই কথা, অথচ মেয়েরা কথা বলছে না। তাদের কথা বলতে ডাকা হয়নি। কেবল শোনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাঁশের ব্যারিকেডে আলাদা ভাবে এক কোণে বসে তাঁরা। আচমকাই সেই বাঁশের ব্যারিকেড ভেঙে মঞ্চে উঠে এসেছিলেন বছর চব্বিশের চন্দ্রপ্রভা সৈকিয়ানি। জোর গলায় অন্য মহিলাদের ডাক দিয়েছিলেন তিনি, মেয়েদের কথা বলার জন্য এগিয়ে আসতে হবে মেয়েদেরই।
অসমের ইতিহাসে নারীকেন্দ্রিক আন্দোলনে বরাবর নেতৃত্ব দিয়েছেন চন্দ্রপ্রভা। জীবনভর লড়ে গিয়েছেন মহিলাদের শিক্ষা ও সমান অধিকারের জন্য। যখন মেয়েদের পড়াশোনার সুযোগটাই কম, সেসময়েই খেলার সঙ্গিনীদের নিজে পড়াতেন তিনি। সেই পড়ানো শুনেই স্কলারশিপ দেন স্কুল সাব-ইনস্পেক্টর। স্কুলে পড়ার সময়েও অন্যায় দেখলেই গর্জে উঠতে ছাড়েননি কিশোরী চন্দ্রপ্রভা। আর দেশ জুড়ে যখন অসহযোগ আন্দোলনের জোয়ার নামল, তখন তাতে ঝাঁপ দিলেন তিনিও। অসমের মহিলাদের সংঘবদ্ধ করার দায়িত্ব নিলেন। সেখান থেকে ১৯২৬ সালে তৈরি হল পুরোদস্তুর মহিলাদের সংগঠন। নাম, প্রাদেশিক মহিলা সমিতি। নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলার পাশাপাশি তা লিপিবদ্ধ করে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজনে শুরু করলেন ‘অভিযাত্রী’ পত্রিকা। আইন অমান্য এবং অসহযোগ আন্দোলনের জন্য দু’বার জেলও হয় চন্দ্রপ্রভার।
আরও শুনুন:
গৃহবধূ থেকে বিপ্লবী, অস্ত্র আইনে প্রথম সশ্রম কারাদণ্ড হয় দুকড়িবালা দেবীর
বাইরে স্বাধীনতার সংগ্রাম, ঘরেও প্রয়োজনে বিদ্রোহ করেছেন চন্দ্রপ্রভা। সেকালে স্বামী-স্ত্রীর বয়সে বিপুল তফাতকেই লোকে স্বাভাবিক ধরে নিত। কিন্তু সেই ফারাকে আপত্তি জানিয়ে বাবা-মার ঠিক করা পাত্রকে বিয়ে করতে রাজি হননি চন্দ্রপ্রভা। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার চাকরি নিয়ে চলে যান তেজপুরে। কবি ও লেখক দণ্ডীনাথ কলিতার প্রেমে পড়েন সেখানেই। কিন্তু সমাজের চোখে দণ্ডীনাথ নিচু জাত, তিনি চন্দ্রপ্রভাকে বিয়ের সাহস দেখাতে পারলেন না। ততদিনে চন্দ্রপ্রভা অন্তঃসত্ত্বা। সমাজের ভয় না করে একা মা বড় করে তুললেন তাঁর সন্তানকে।
নারীশিক্ষা থেকে নারীমুক্তির জন্যেই আজীবনের লড়াই ছিল তাঁর। কেবল ভাবনায় নয়, নিজের জীবন দিয়েই নারী আন্দোলনকে রূপ দিয়েছিলেন চন্দ্রপ্রভা। মেয়েদের চলার পথকে আরও একটু বাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছেন এই বিপ্লবী নারী।