ইলিশ না বিরিয়ানি- ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? মুজতবা আলী ইলিশের পক্ষেই। বিবেকানন্দের ইলিশ-প্রীতি তো কিংবদন্তি। বাঙালির পাতে আর সাহিত্যের পাতায় ইলিশের সুঘ্রাণ। যুগ বদলায়। সরকার বদলায়। ইলিশের টান বদলায় না। স্মৃতি-সত্তায় জমে থাকে ইলিশ-কিস্সার সন্ধানে রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
একবার স্টিমারে চড়ে গোয়ালন্দে চলেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। পথে একটা নৌকার দিকে চোখ গেল। জেলেদের জাল জুড়ে রূপসি ইলিশ। তা দেখেই রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে পড়লেন স্বামীজি। সঙ্গী কানাইকে নির্দেশ দিলেন, টাটকা ইলিশ কিনে নিতে। দলে রয়েছেন মোট সাতজন। তিনটি বা চারটি ইলিশ কিনলেই সকলের হয়ে যাবে, মত সঙ্গীর। স্বামীজি ধমক দিয়ে বললেন, আমরা ক’জন মিলে খাব আর স্টিমারের খালাসি-মাঝিমাল্লারা চেয়ে দেখবে? সন্ন্যাসী তিনি। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছেড়ে পথে বেরিয়েছেন। কিন্তু তার বদলে সারা বিশ্বকেই যে জড়িয়ে নিয়েছেন দুহাতে। তাই স্টিমারের খালাসিদের কথা অবধি তাঁর চোখ এড়িয়ে যায় না। সেদিন শেষ পর্যন্ত কেনা হয়েছিল ষোলোটি ইলিশ। কত দামে? এক-একটি মাছ চার পয়সা করে, তাই মোট দাম পড়ল এক টাকা। এবার স্বামীজির আকাঙ্ক্ষা: ‘পুঁইশাক হলে বেশ হত, সঙ্গে গরম ভাত।’ স্টিমার এক গ্রামের পাশে দাঁড় করিয়ে এক গ্রামবাসীর বাগান থেকে আনা হল পুঁইশাক। আর ইলিশের মুড়ো দিয়ে সেই শাক খেয়ে আহ্লাদিত স্বামী বিবেকানন্দ কী করলেন? ফেরার পথে দীক্ষা দিয়ে গেলেন পুঁইশাকের মালিককেই।
এক টাকায় ষোলোটি ইলিশ! এ গল্প এখন শুনলে মনে হবে রূপকথা। বুদ্ধদেব বসু যাকে জলের রুপোলি শস্য বলেছেন, সেই ইলিশের দাম এখন রুপোর সঙ্গেই পাল্লা দিতে পারে দিব্যি। এখন কেন, বেশ ক’বছর আগেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চমকে উঠেছিলেন ইলিশের দাম ছ’সাতশো টাকা হয়েছে শুনে। অথচ প্রফুল্ল রায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় শুনিয়েছেন ছোটবেলায় দাদুর সঙ্গে নৌকা চড়ে বাজারে যাওয়ার গল্প। ওপার বাংলার সে বাজারে তাঁরা আড়ত থেকে ইলিশ কিনেছিলেন টাকায় দু’জোড়া। ইলিশের স্বাদ যেমন উপভোগের, সে মাছ কেনার দরাদরিও কম উপভোগ্য নয়। আবার নাতির প্রথম দিন বাজারে আসার উপহার হিসেবে একখানা ইলিশ ফাউ দিয়েছিলেন খোদ আড়ত মালিক।
সেই প্রফুল্ল রায়ই আবার ইলিশ ধরা আর নোনা ইলিশ জমিয়ে রাখার মন্ত্রগুপ্তি নিয়ে লিখে ফেলেন ‘রসুল মাঝির গল্প’। “পদ্মা কি মেঘনার তিরিশ-চল্লিশ হাত জলতল থেকে একান্তে অবলীলায় ইলিশ মাছ তুলে আনে রসুল। কিন্তু নিকারীদের মেয়ে বোধহয় মেঘনা-পদ্মার ইলিশের চেয়েও গভীরচারী। সহজে আজিমা ধরা দেয় না।” ইলিশ আর মেয়েমানুষ জড়িয়ে যায় বাংলার আরও এক বিখ্যাত উপন্যাসেও। “পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরার মরশুম চলিয়াছে। দিবারাত্রি কোনো সময়েই মাছ ধরিবার কামাই নাই।”- এই ছবি এঁকেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শুরু করেছিলেন তাঁর ‘পদ্মানদীর মাঝি’। বাঙালির সঙ্গে ইলিশের যেমন প্রাণের যোগ, বাঙালির সাহিত্যেও যে ইলিশ জড়িয়েই যাবে তাতে আর আশ্চর্য কী! রবীন্দ্রনাথ অবশ্য রমেশকে রুই মাছ আর মহেন্দ্র-বিহারীকে তপসে মাছ খাইয়েই আপ্যায়ন করেছিলেন। কিন্তু বিভূতিভূষণের গরিব রাঁধুনি বামুন হাজারি ঠাকুর যখন বিনা দোষে জেল খাটার পর কন্যাসমা কুসুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়, তার জন্য সেই গরিব মেয়েটিও ইলিশ মাছ রাঁধে। আরেক বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদিন্দুর কলমেও ইলিশ খেতে পায় নেহাত সাধারণ মানুষও। তার পিতা আসলে গৌড়ের রাজা মানবদেব, এ কথা জেনে বাংলার কোন শান্ত গ্রাম থেকে পিতাকে খুঁজতে রাজধানী গৌড়ে এসে পৌঁছেছিল বজ্র। আয়ি আর তার নাতনির ছোট্ট কুটিরে আশ্রয় পাওয়ার পর রাতে তার খিদে মিটিয়েছিল ওবেলার রান্না ইলিশের ব্যঞ্জন। আবার ‘রিমঝিম’-এ কলকাতা শহরের সেই সাধারণ একলা নার্স? বিশেষ কিছু রান্না না করার দিনে তারও খাদ্য ইলিশ মাছ আর ডিম ভাতে।
তবে ধনী হোক কি গরিব, ইলিশের স্বাদে বাঙালি কিন্তু বরাবর মজে ছিল না। মাছে ভাতে বাঙালি বটে, কিন্তু রোহিত মৎস্যকেই তখন সে সেরার মর্যাদা দেয়। তার পাতে থাকে মৌরলা মাছ, থাকে চিতলের কোল, কই, মাগুর, এমনকি চিংড়িও। কিন্তু পুরনো লেখাপত্রে ইলিশ প্রায় বেপাত্তা। তবে হ্যাঁ, পূর্ববঙ্গের লোক বিজয়গুপ্ত কিন্তু ‘মনসামঙ্গল’-এ লিখলেন, ডুমো ডুমো করে কাটা মানকচু দিয়ে শোলমাছের পদ, মাগুর মাছের ঝুরি, আর ফালা ফালা করে কাটা ইলিশ মাছে ‘দক্ষিণসাগর কলা’ দিয়ে রান্নার কথা। মনসামঙ্গলেই জানা গেল, সর্ষে শাক দিয়ে ইলিশ রান্না করে লখিন্দরকে খাওয়াচ্ছে বেহুলার ভ্রাতৃবধূ। আরও শ’খানেক বছর পরে ‘শিবায়ন’ কাব্যে রামেশ্বর চক্রবর্তী ইলিশের কথা বলতে ভোলেননি। আর অন্নদামঙ্গল-এ ভারতচন্দ্রও বলছেন ‘পাঙ্গাস ইলিশা’-র নাম। আশ্চর্যের কথা হল, এসব কাহিনিকাব্যে ইলিশের তেমন কদর নেই, অথচ এর অনেক আগেই তো ইলিশকে নিয়ে উদ্ভট শ্লোকের দেখা মিলেছে। তাও কী কারণে? না, নিরামিষ খাওয়ার পথে কাঁটা দিতে। শ্লোক রচয়িতা জানিয়ে দিচ্ছেন- ইলিশ খলিশশ্চৈব ভেটকি মদগুর এব চ। রোহিতো মৎস্যরাজেন্দ্র পঞ্চমৎস্য নিরামিষাঃ।। – যার অর্থ, ইলিশ, খলসে, ভেটকি, মাগুর ও রুই- এই পাঁচটি মাছকে নিরামিষ বলে ধরা হবে। এ থেকে তো বোঝাই যায়, ইলিশ ভোজনের জন্য সেকালেও মানুষজন কম ব্যাকুল ছিলেন না। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের মাছ খাওয়া নিয়ে পাছে কথা ওঠে, তাই আগেভাগেই শ্লোক হাতিয়ার করে খুলে রাখা গেল ইলিশ খাওয়ার পথ। সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হলেও ইলিশের প্রতি আসক্তি দেখিয়েছেন বিবেকানন্দও, সে গল্প তো আগেই বলেছি। ১৯০১ সালের ৬ জুলাই বেলুড় মঠে বসেই ক্রিস্টিনকে চিঠিতে সে কথা লিখেছিলেন বিবেকানন্দ। আষাঢ়ের আকাশ, তার নিচে বিছিয়ে আছে গঙ্গার জল। বেলুড় তখনও সবুজ, তখনও নির্জন। সেই নিশ্চুপ শান্তির মধ্যেও সন্ন্যাসীর কাজ ভুলিয়ে দেয় জেলেদের ইলিশ ধরার আনন্দ। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “নদীতে ইলিশ উঠেছে। লিখছি আর দেখছি। ঘরের গায়ে ঢেউ ধাক্কা খেয়ে উছলে উঠছে। নিচে শত শত মাছ ধরার নৌকা সবাই ধরায় ব্যস্ত।” সঙ্গে ইলিশের দরাজ প্রশংসা করে বিদেশিনি শিষ্যাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, পৃথিবীতে এমন জিনিসটি হয় না।
এ চিঠির প্রায় বছরখানেক পরে আরেক বর্ষাকালের কথা। সে দিনই মঠে কেনা হয়েছিল সে বছরের প্রথম ইলিশ। তার দাম নিয়ে খুনসুটি করেছেন স্বামীজি। প্রমাণ মাপের ইলিশ দেখে পূর্ববঙ্গীয় শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে ডেকে বলেছেন, ‘তোরা নূতন ইলিশ পেলে নাকি পূজা করিস, কী দিয়ে পূজা করতে হয় কর।’ স্বামী প্রেমানন্দ লিখেছেন, ‘…আহারের সময় অতি তৃপ্তির সহিত সেই ইলিশ মাছের ঝোল, অম্বল, ভাজা দিয়া ভোজন করিলেন।’ তৃপ্তিভরে খেয়ে উঠে আবার মজা করে বললেন, ‘একাদশী করে খিদেটা খুব বেড়েছে, ঘটিবাটিগুলো ছেড়েছি কষ্টে।’ সেদিনটা ১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই। ইলিশ দিয়েই সেদিন শেষবারের মতো মধ্যাহ্নভোজন করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য পরে মজার ছলেই এ প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “খুব ভালো জিনিস একসঙ্গে বেশি আহার করতে নেই। বাঙালদের তবু অভ্যাস আছে। বিবেকানন্দ বাঙাল ছিলেন না। তাই সহ্য করতে পারেননি।”
সুনীলের কথার সমর্থনেই বলা যায়, ইলিশ মাছ খাওয়ার পর মৃত্যু হয়েছিল এক বিখ্যাত ব্যক্তির। তিনিও কোনও মতেই ওপার বাংলার মানুষ নন, এমনকি বাঙালিই নন। ইতিহাসে যাঁকে পাগলা রাজা বলা হয়, বলছি সেই সম্রাট মুহম্মদ-বিন তুঘলকের কথা। তিনি গুজরাটে গিয়েছেন বিদ্রোহীদের দমন করতে। নৌকায় চেপে তাদের তাড়া করতেও সম্রাটের খুব উৎসাহ। তারই মধ্যে এক বিকেলে হঠাৎ একটা মাছ লাফিয়ে উঠে পড়ল নৌকার ওপর। ঝকঝকে সাদা রং, তার গড়নটিও চমৎকার। মাছটি দেখে সম্রাট খুবই কৌতূহলী হয়ে পড়লেন। এটা কী মাছ, কেউ জানে না। তুঘলক বললেন, এটাকে এক্ষুনি কেটেকুটে রান্না করে দাও। আমি খেয়ে দেখব। তা শুনে তাঁর মন্ত্রী ও পরিষদরা আঁতকে উঠলেন। তাঁরা সম্রাটকে অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে, এই মাছ বিষাক্ত কি-না তা তাঁর জানা নেই, তা ছাড়া এখন রোজার মাস চলছে, সুতরাং এখন এই মাছ সম্রাটের মুখে ছোঁয়ানোই উচিত নয়। জেদি সম্রাট কারো উপদেশ গ্রাহ্য করলেন না। তাঁর আদেশে তিনি সেই মাছ রান্না করালেন এবং খেলেন। খুব সম্ভবত অনেকটাই খেয়ে ফেলেন, আর সেই কারণেই কি না কে জানে, কয়েক দিনের মধ্যেই মৃত্যু হল তাঁর। – এ গল্প শুনিয়ে সরস টিপ্পনি কেটেছিলেন ওপার বাংলার মানুষ মুজতবা আলী, সেই অচেনা মাছটি ইলিশই ছিল এবং ইলিশ খেয়ে যখন সম্রাটের মৃত্যু হয়েছে, তখন নিশ্চিত তিনি বেহেশতে গেছেন।
ইলিশের প্রতি এমনই প্রীতি ছিল মুজতবা আলীর যে, ইলিশের চেয়ে মাংসের বিরিয়ানি কাছে টানার ‘অপরাধে’ এক অধ্যাপকের সঙ্গে সপ্তাহখানেক কথা বন্ধ করে দেন তিনি। তাঁর বক্তব্য ছিল, দাওয়াতে ইলিশ থাকলে সেটাই হবে এক ও অদ্বিতীয়। দাওয়াত হতে হবে ইলিশময়। মাংস নৈব নৈব চ। ইলিশের গুণকীর্তনে পঞ্চমুখ ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আবার ইলিশে কাঁটা সহ্য করতেও নারাজ ছিলেন। কলকাতা শহরের দুঃখকে তিনি তিনটি ভাগ করে বলেছিলেন: প্রথম দুঃখ হল ভদ্দরলোকদের, ট্রামগাড়িতে উঠলে ভাড়া দিতে হয়; দ্বিতীয় দুঃখ, মেয়েদের স্বামীকে আপিস যেতে ছেড়ে দিতে হয়, তৃতীয়, ইলিশ হেন মাছ, তাতে আবার কাঁটা হয়। যদিও এ কিসসার পালটা দিয়েছিলেন কল্যাণী দত্ত। তাঁর কথায়, “সভয়ে বলি, আদপে কাঁটা না থাকলে মুড়ো চুষে রস পেতুম কি?”