জ্যাভলিনে নীরজকে ছাপিয়ে সোনা জিতেছেন পাকিস্তানের নাদিম। তাতে এতটুকু আক্ষেপ নেই নীরজের মা সরোজ দেবীর। বরং সোনাজয়ী নাদিমকেও নিজের ছেলে বলেই পরিচয় দিলেন তিনি। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
টোকিও অলিম্পিক্সে সোনা ঝলসে উঠেছিল নীরজ চোপড়ার জ্যাভলিনে। প্যারিস অলিম্পিক্সের আসরে তাঁর জ্যাভলিন ছুটে গিয়েছে আরও দূরে। তবে তাতেও সোনা আসেনি। কারণ অতিমানবিক শক্তিতে নিজের জ্যাভলিন ছুড়েছেন আরশাদ নাদিম। যাঁর জার্সিতে আঁকা পাকিস্তানের পতাকা। তাঁর জোরেই ভারতকে হারিয়ে সোনা জিতে নিয়েছে পাকিস্তান।
গল্পটা এরপরই প্রত্যাশিত মোড় নিতে পারত। কে না জানে, ভারত আর পাকিস্তান এই দুটো দেশের নাম পাশাপাশি এলেই গাঁথা পড়ে যায় শত্রুতার সুতোয়। পাক প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে নীরজের পিছিয়ে পড়ায় লেখা হতে পারত সেই চেনা শত্রুতারই বয়ান। কিন্তু সেই সাম্প্রদায়িক উস্কানির জ্যাভলিনটাকে বহুদূর ছুড়ে ফেলে দিলেন নীরজের মা। কোনও অলিম্পিক রেকর্ডও যাকে ছুঁতে পারবে না। নীরজের মা সরোজ সব প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে যেন এক কথায় মুছে দিয়ে বললেন, এক সন্তান সোনা না জিতুক, আরেক সন্তান তো সোনা জিতেছে। সোনাজয়ী নাদিমও তাঁরই সন্তান। যখন আমাদের আনন্দ দুঃখ, উল্লাস আর আক্ষেপ সবকিছুরই ভাষা লেখা হচ্ছে ঘৃণার অক্ষরে, অন্যকে পিষে দিতে চাওয়ার উগ্র বাসনায়- সেই সময়েই নীরজ চোপড়ার মা আমাদের শিক্ষা দিলেন। সহমর্মিতা আর সহিষ্ণুতার শিক্ষা। যদিও তাঁর পক্ষে এ ঘটনা নতুন নয়। এই তো বছরখানেক আগেই ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছিলেন নীরজ। পাক প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাস্ত করেই এসেছিল সে বিশ্বজয়ের মুহূর্ত, সুতরাং বাড়তি আনন্দের রসদ লুকিয়ে ছিল বইকি। কিন্তু রাজনীতির সেই চলতি ইঙ্গিতকে না ধরে, নীরজের মা সেবারই স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন, একজন অ্যাথলিটের সবথেকে বড় পরিচয় এই যে তিনি একজন অ্যাথলিট। তিনি পাকিস্তানের নাকি হরিয়ানার তা বিবেচ্য বিষয় নয়। তাও নাহয় সেবারটা ছিল নীরজের জয়ের মুহূর্ত। কিন্তু সোনা হারানোর পরও সেই একই সুরে নাদিমকে সন্তানের তকমা দিয়ে নীরজের মা বুঝিয়ে দিলেন, তিনি সেদিন কোনও উদারতা দেখাননি। একজন মায়ের পক্ষে যা স্বাভাবিক, সবাইকে কোলে টেনে নেওয়া- সেই আপন করার পাঠ তিনি জিইয়ে রেখেছেন কেবল। মনে পড়তে পারে, সম্প্রতি টিম ইন্ডিয়ার বিশ্বকাপ জয়ের পরেও রোহিত শর্মার মা বিরাট আর রোহিতকে দুই ভাই বলে আপন করে নিয়েছিলেন। যাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার দুই প্রান্তে বসিয়ে জল্পনা চলে, সন্তান বলে আপন করে নিয়েই সেইসব জল্পনা তিনি মুছে দিয়েছিলেন। তাও তাঁরা একই দেশের মানুষ, একই দলের খেলোয়াড়। নীরজ আর নাদিম তা নন। ঘটনাচক্রে তাঁরা এমন দুই দেশের মানুষ, যাদের নিয়তিতে জড়িয়ে গিয়েছে পুরনো শত্রুতার অভিশাপ। ধর্মকে পাহাড়প্রমাণ গুরুত্ব দেওয়ার এ যুগে তাঁদের আলাদা ধর্ম নিয়েই ঘনিয়ে উঠতে পারে দ্বৈরথ। কিন্তু জাতি ধর্ম দেশ দল, সবরকম বিভাজনকে মুছে দেওয়া আসলে মায়ের পক্ষেই সহজ, স্বাভাবিক। মনে পড়তে পারে নজরুলের সেই কথাও- “হিন্দু না ওরা মুসলিম, ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?/ কাণ্ডারী, বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র।” ন্যাশনালিজমের জোয়ারে দেশই যখন মাতৃপ্রতিমা হয়ে উঠছে, তখনও সকলেই তার সন্তান। একই বৃন্তে দুটি কুসুমের মতোই, একই মায়ের দুই সন্তান। হলই বা তাদের ধর্ম আলাদা, আলাদা ভাষা, আলাদা সংস্কৃতি। মায়ের স্নেহ-মমতার জোয়ারে ধুয়ে যায় যাবতীয় ভেদ।
আসলে ভারতবর্ষের মধ্যে এই আপন করার মনোভাব তো জেগে ছিলই। সেই গ্রহিষ্ণুতা আরও বেশি করে সত্যি হয়ে উঠেছিল মাতৃত্বে। কেবল জৈবিক মাতৃত্বের কথা বলা হচ্ছে না। মাতৃত্বের যে বোধ, সেখানেই ওতপ্রোত হয়ে ছিল অপরকে আপন করে নিতে পারা। বৈদিক সাহিত্যে প্রকৃতি কিংবা মানুষী মায়ের প্রসঙ্গে জড়িয়ে আছে সেই সংলগ্নতা। সকলের কল্যাণের ভাবনা। সেই বোধ থেকেই এই দেশের এক মা বলতে পারেন, “আমি সতেরও মা, অসতেরও মা।” হ্যাঁ, মা সারদা তাঁর সন্ন্যাসী সন্তানদের যেমন ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছেন, তেমনই গরু চুরির দায়ে ধরা পড়া মুসলিম ডাকাত আমজাদ কিংবা পানাসক্ত পদ্মবিনোদের প্রতিও তাঁর হৃদয় করুণায় বিগলিত। নলিনীদিদিকে বলেন, “আমার শরৎ যেমন ছেলে, এই আমজাদও তেমন ছেলে।” আবার বৃদ্ধা মাঝি-বউয়ের ছেলে মারা গিয়েছে শুনে তাঁর সঙ্গে এক সুরে কেঁদে ওঠেন তিনি। সেবকের মনে হয়, দুই মা-ই সন্তান শোকে কাঁদছেন, কার সন্তান বোঝা যাচ্ছে না।
এ দেশ ধর্মের গণ্ডি টেনে মাতৃপূজা দেখেছে। দেখেছে জাতীয়তাবাদের নামে প্রচণ্ডা মাতৃমূর্তি। যেখানে মায়ের নামেই অপরকে আঘাতের পথে ছুটে গিয়েছে সন্তান দল। আবার তার বিপরীতে মা সারদার মতো এমন সহিষ্ণু মাতৃপ্রতিমাকেও ধারণ করেছে ভারতবর্ষ। ধর্মের প্রেক্ষিতে, বিপ্লবের প্রেক্ষিতেও। প্রতিবাদে-মিছিলে যে স্বাভাবিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকে, সেখানেও যে একরকমের গ্রহিষ্ণুতা জারি থাকতে পারে, সে বোধ চারিয়ে গিয়েছে মায়েদের মধ্যে দিয়েই। গোর্কির মায়ের মতোই, সব শহিদের জন্য আঁচল বিছিয়ে দিয়েছেন হাজার চুরাশির মা। আজকের ভারতে যখন অপরত্বই ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে, সেখানে আরও একবার সেই প্রাচীন গ্রহিষ্ণুতার পাঠ দিয়েই যেন ভারতজননী হয়ে উঠলেন নীরজের মা।