ইলিশ বাঙালিকে করে তোলে প্রেমিক। দার্শনিক-ও। ইলিশে বাঙালি রাজা। ইলিশেই ফকির। ইলিশ বাঙালির বিয়াত্রিচে অথবা ডেসডিমোনা। দাম কমানো আর যার জন্যই হোক ইলিশে প্রযোজ্য নয়। ইলিশে বাঙালি দিলদরিয়া। ইলিশ-ই বাঙালির দন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। জীবনমুখী গান। ইলিশে সঁপিয়া প্রাণ বাঙালি দিব্যি আছে! ইলিশ-বাঙালি সম্পর্কের জল গড়ায় বহুদূর, ইতিহাস থেকে মহাকালে। কে তার নাগাল পায়! বৃথা চেষ্টায় রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
প্রেম ছাড়া জগতে আর যা কিছু নিয়ে বাঙালির আবেগ ও কাব্যে ভাটা পড়ে না, সে তালিকায় ইলিশ সগৌরবে হাজির। ইলিশ মাছের সঙ্গে বাঙালির কেবল পেটের নয়, প্রাণের টান। মহারাজা থেকে সন্ন্যাসী, কে না জড়িয়েছেন ইলিশের জালে! আসলে জিভে যতখানি স্বাদ, তাতে নুনঝাল জুড়ে দেয় স্মৃতির ফোড়ন। আর দুয়ে মিলেই পাত সাজায় বাঙালি। বাঙালির সে স্মৃতি সত্তায় ইলিশের চিরবসত। একটা গোটা জাতির জনজীবনে আর কোনও খাবার এতখানি গুরুত্ব পেয়েছে, এমনটা তো সচরাচর দেখা যায় না। অনেক বাড়িতে নিয়ম ছিল, সরস্বতী পুজোর দিন ধান দূর্বা সিঁদুর দিয়ে বরণ করে ঘরে তোলা হবে জোড়া ইলিশ। সেই দিন থেকে ইলিশ মাছ খাওয়ার শুরু, আর তা শেষ হবে দশমীর দিন আবার জোড়া ইলিশ খেয়ে। আসলে মাঝের সময়টা ইলিশ মাছের গর্ভধারণের সময়, সেই কথা ভেবেই হয়তো এহেন নিয়ম জারি করা হয়েছিল। ভাবছেন, এতগুলো দিন ইলিশের স্বাদ ভুলে থাকতে হত? উঁহু। ‘নোনা ইলিশ’ আছে তো! চার-পাঁচ মাস ধরে নুন হলুদ দিয়ে জারিয়ে, পাতায় মুড়ে, রান্নার উনুনের পাশে রেখে, হাজারও তরিবত করে রেখে দেওয়া হত ইলিশ মাছ! আর যখন তাজা ইলিশ পাওয়া যায় তখন তো রান্নার ধুম। কতরকমের নাম সেসব পদের! ইলিশ ভাপা, আনারস ইলিশ, ইলিশের অম্বল, ল্যাঞ্জাভর্তা, ইলিশ মাছের উল্লাস থেকে ‘ধূমপক্ব ইলিশ’, অর্থাৎ কিনা ‘স্মোকড হিলসা’। সাহেবরা কাঁটাও বাছবেন না আবার ইলিশও ছাড়বেন না, সেইজন্য এই পদের উদ্ভব। উনিশ শতকের ঠাকুরবাড়িতে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীও মেনুকার্ডে রাখেন সেই ধূমপক্ব ইলিশ।
তাজা ইলিশের মতোই কাঁচা ইলিশ কেনার গল্প মনে করেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বলেছেন, “আমরা বাল্যকাল থেকে ইলিশের সমঝদার। আমার মতন এমন মানুষ খুব কমই আছে, যে জ্যান্ত ইলিশকে লাফাতে দেখেছে। ছোট ইলিশ কখনো খেতাম না, আর বরফের ইলিশ তো ছুঁয়ে দেখারও প্রশ্ন ছিল না।” বাজারে গিয়ে বরফে রাখা মাছ দেখে লেখক যখন দোলাচলে, তখনই পরিচিত মাছওয়ালার আশ্বাস, “দাঁড়ান স্যার, আপনার জন্য আমি কাঁচা মাছ এনে দিচ্ছি।” সুনীলের টিপ্পনি, “কাঁচা মাছ কাকে বলে তা আমি জানি। বরফ ছাড়া। টাটকা। কোনো কারণে এই মাছ এরা আড়ালে লুকিয়ে রাখে।” সে মাছের স্বাদ হয়তো সেই ছোটবেলার স্মৃতি ছুঁতে পারে, তবে তার দামের সঙ্গে পুরনো দিনের বিন্দুমাত্র তালমিল নেই। ছোটবেলার বাংলাদেশে এক টাকায় দু’জোড়া ইলিশ, সঙ্গে আরও একখানা ফাউ পেয়েছিলেন প্রফুল্ল রায়। কলকাতাও তখন এত দামি হয়ে ওঠেনি। ‘স্মৃতির শহর’-এ সুনীলই লিখেছিলেন, সস্তায় পেলেন তাই যমজ ইলিশ নিয়ে/ বাবা ফিরলেন বাড়ি রাত্তির নটায়”- সে সুখের দিন এখন স্মৃতির পাহাড় ডিঙিয়েও আর ছোঁয়া যায় না। অথচ মধ্যবিত্তের হাতের নাগালে ইলিশ না পাওয়া গেলে কি আর ‘কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে–ঘরে ইলিশ ভাজার গন্ধ’ ও ‘সরস সর্ষের ঝাঁজে’ বর্ষার সঙ্গে ‘ইলিশ উৎসব’–এর যুগলবন্দির সাক্ষী হতে পারতেন বুদ্ধদেব বসু! কিংবা বিভূতিভূষণের ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’? বর্ষা থেকে শুরু করে যতদিন বাজারে পাওয়া যায়, ততদিনই ইলিশের বন্দোবস্ত। হাজারি ঠাকুরের হাতের জাদুতে সে ইলিশের কেমন তার খুলত, সে কথা ভেবে এখনকার বাঙালিরও জিভে জল আসে।
অবশ্য যে ইলিশে বাঙালির স্বাদকোরক মশগুল, সে ইলিশের রান্না নিয়ে বাঙালির স্মৃতির ভাঁড়ার উপচে পড়ারই কথা। সর্ষে শাক দিয়ে ইলিশ রান্না করে লখিন্দরকে খাইয়েছিল বেহুলার ভাইয়ের বউ, সে তো কবেকার কথা। বেহুলার বাবা পাত্রপক্ষকে যে পনেরো পদের মাছ দিয়ে আপ্যায়ন করেন, সেখানেও ইলিশভাজা ছাড়া চলেনি। কবিতায় ইলিশের স্মৃতির সঙ্গে যেমন সুনীলের কাছে একাকার সেদিনের তুমুল বৃষ্টির রাত। যেন পাহাড় থেকে নেমে আসা জলপ্রপাতে রান্নাঘর মাখামাখি। আর সেখানে উনুন বাঁচিয়ে ছাতা মেলে ধরেছেন বাবা। রন্ধনবিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিমবঙ্গে ইলিশ মাছে পেঁয়াজ–রসুন ও আলু–আদার রেওয়াজ নেই। তার মোক্ষম যুক্তি হল, পেঁয়াজ–রসুন ইলিশের নিজস্ব গন্ধে ভাগ বসায়। তবে ওপার বাংলার মত অন্য, পথও ভিন্ন। মাংসের বিরিয়ানির পাশে ইলিশের সহাবস্থানও সেখানে ঘটে যায় অনায়াসেই। ইলিশের মসনদে এমন শরিকি ভাগ মানতে নেহাত নারাজ ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। ইলিশের চেয়ে মাংসের বিরিয়ানি কাছে টানার ‘অপরাধে’ এক অধ্যাপকের সঙ্গে এক সপ্তাহ কথা বন্ধ রেখেছিলেন তিনি।
ইলিশ নিয়ে এমন ঝগড়াও কি বাঙালির কাছে অপরিচিত? এককালে ইস্টবেঙ্গল লিগ জিতলে সমর্থকেরা বাড়ি ফিরতেন হাতে জোড়া ইলিশ ঝুলিয়ে। প্রবীণেরা মনে করতে পারেন, মোহনবাগান জিতলে বাজারে চিংড়ির দাম বেড়ে যেত, আর ইস্টবেঙ্গল জিতলে ইলিশ। অথচ, ফুটবল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের এই বিভাজিত বাঙালি যখন গঙ্গা–পদ্মার ইলিশের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের বিচার করতে বসত, তখন তারাই একজোট হয়ে ঝোল টানত গঙ্গার কোলে। কমলকুমার মজুমদার তো বলেই দিয়েছেন, “গঙ্গার ইলিশ দুশো বছর ধরে কোম্পানির তেল খেয়েছে। এই ইলিশের সাথে অন্য ইলিশ পাল্লা দেবে কী করে?” যদিও বাঙালের যুক্তি হল, এ কথা বলা, আর লেনিন মার্ক্সবাদ বুঝতেন না বলা একই কথা। সে যা হোক, ঝগড়া কিন্তু কেবল গঙ্গা-পদ্মার ইলিশের গুণ বিচারেই থামেনি। গঙ্গার ইলিশেও ভালো আর কম ভালোর গুণাগুণ বিচারে তৎপর ছিল সেকালের বাঙালি। ‘থোড় বড়ি খাড়া’-য় কল্যাণী দত্ত লিখছেন খাস কলকাতার এক সেন পরিবারের ইলিশ নিয়ে খুঁতখুঁতে হওয়ার গল্প। তাঁর কথায়-
‘আমাদের একবার সাহস হয়েছিল এঁদের বাড়িতে টাটকা গঙ্গার ইলিশ উপহার দেবার। তা দেওয়া মাত্রই বললেন, ইলিশ মাছ, কোন ঘাটের লা? বাড়ি থেকে জেনে এসে বললুম, ‘তক্তাঘাটের, মা পাঠিয়ে দিলেন, বাবার বন্ধুরা সবাই মিলে অনেক ইলিশ এনেচেন কিনা।’ উত্তর পেলুম, “ম্যাগে, তক্তাঘাট, চিবুতে চিবুতে যে চোয়ালে ব্যথা ধরে যাবে। আমরা খেতুম কুমোরটুলি নইলে বাগবাজার ঘাটের মাছ। তা সেগুলো মা সিদ্ধেশ্বরীর পা-ধোয়ানি জল খেয়ে খেয়ে কেমন গোলাপি বন্ন যে হত, তোকে আর কী বলব? ঘাটে ঘাটে যে “তার” বলায় তা তো জানিসনি!’
কল্যাণী দত্ত ইলিশ নিয়ে পাত বেড়েছেন বটে, তবে তাঁর চোখে মীনশিরোমণি হল চিংড়ি, আর ইলিশ তাঁর কাছে তকমা পেয়েছে যুবরাজের। তবে আরেক দত্তকুলোদ্ভব, খাস ঘটি নরেন্দ্রনাথ দত্ত যেভাবে ইলিশ মাছকে মান্যতা দিয়েছেন, তাতে ইলিশপ্রেমীদের দুঃখের আর জায়গা নেই। সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হলে কী হয়, ইলিশকে কিন্তু ত্যাগ করেননি স্বামী বিবেকানন্দ। রবীন্দ্রনাথের ইলিশপ্রীতি সম্পর্কে তেমন কোনও তথ্য জানা যায় না বটে, তবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অনুমান করেছিলেন, “পদ্মার ওপর বোটে অনেক দিন চেপেছেন, মাঝেমধ্যে কি ইলিশ চেখে দেখেননি?” তা ছাড়া আবদুল মাঝির কথাও তো তিনি নিজেই লিখেছেন। সেই আবদুল মাঝি, পদ্মা থেকে দাদাকে ইলিশ মাছ আর কচ্ছপের ডিম এনে দেওয়ার সূত্র ধরেই যার সঙ্গে চেনাজানা কিশোর রবির। এমনকি ‘চিরকুমার সভা’ নাটকে প্রতিজ্ঞা রাখার সঙ্গেও তিনি তুলনা টেনেছেন সেই ইলিশ মাছেরই। বলছেন, “ইলিশ মাছ অমনি দিব্যি থাকে, ধরলেই মারা যায়- প্রতিজ্ঞাও ঠিক তাই, তাকে বাঁধলেই তার সর্বনাশ।” ভাবা যায়, কথা রাখা আর না রাখতে পারার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে ইলিশ মাছকে! রবীন্দ্রনাথ একা নন, তাঁরও অনেক আগে, ১৮৭১ সালে শ্রীরামপুর থেকে ‘পরমার্থ বিজ্ঞান’ বলে একখানা ছোটো বই বেরোয়। সেখানে লেখক কেশব কর্মকার সুখদুঃখের অনুভূতি আর মনের বয়েস নিয়ে আলোচনা করতে করতে বলেছিলেন, ‘আমাদের যৌবনে একটি ইলিশ মাছ ভাজলে তার সুগন্ধে পাড়া ভরে যেত, এখন তো তা হয় না। ইলিশ মাছ গন্ধ হারাচ্চে, না আমাদের মনের আনন্দ পাবার ক্ষমতা চলে যাচ্চে, কোনটা ঠিক?’ এ গল্প শুনিয়ে কল্যাণী দত্ত আক্ষেপ করেছিলেন, “দর্শন বিজ্ঞানের কথা বলতে গিয়ে যে মানুষেরা ইলিশ মাছকে টেনে আনতে পারেন তাদের তুল্য গুণীরা গেলেন কোথায়? মাছের সঙ্গে যেন রসিকেরাও নিপাত্তা।” শুধু ইলিশ মাছ কেন, জীবনের যাবতীয় রস হারিয়ে ফেলতে ফেলতে সেই আক্ষেপটুকুই বুঝি এখন পড়ে আছে বাঙালির শেষপাতে।