বাংলার রাজনীতিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্ভবত এমন পাঠ্য, যাঁকে ঠিক-ভুলের বাইনারিতে ফেলে দেওয়া সম্ভব নয়। বরং একটা নির্দিষ্ট পথের সন্ধানে যে-দ্বন্দ্ব, সেই দ্বন্দ্বের বাস্তবতাতেই বুঝে নিতে হয় তাঁকে এবং তাঁর রাজনীতিকে। প্রয়াত বঙ্গনেতার ফেলে আসা পথে হাঁটলেন সরোজ দরবার।
স্বীকার, অস্বীকার এবং পুনরাবিষ্কার। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে রাজনৈতিক সচেতন বাংলার মানুষের সম্পর্ক যেন ঘোরাফেরা করেছে এই তিন বিন্দুতে। বুদ্ধদেব এমন মানুষ যাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সকলেই স্বীকার করেছেন সম্ভ্রমে। সংস্কৃতির চর্চা এবং সেই সূত্রে রাজনীতির বৃহত্তর ক্ষেত্রটিকে সুসংস্কৃত করে তোলা, সবার উপরে স্বচ্ছ প্রশাসনের যে-স্বপ্ন তিনি দেখতেন, তা বাঙালি একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছিল। আবার তাঁর রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন তোলার লোকেরও অভাব ছিল না। অনেকে আজও ভেবে থাকেন যে, রাজ্যের সার্বিক উন্নতিচিন্তায় বুদ্ধদেবের ভাবনায় বিশেষ গলদ ছিল না। তবে পদ্ধতিগত প্রয়োগের ক্ষেত্রে তিনি আর একটু নজর দিতে পারতেন। বঙ্গসমাজে কান পাতলে আজও শোনা যায় আক্ষেপ- দ্রুত বদলের লক্ষ্যে একটু কি তাড়াহুড়ো করে ফেলেছিলেন! আর একটু যদি ভাবতেন!
আরও শুনুন:
বিতর্কিত, নন্দিত এবং নিন্দিত… লাল নিশান হাতে বরাবর ব্যতিক্রমী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
এই ‘আর একটু’র পথ মিশে গিয়েছিল রাজ্যের রাজনৈতিক পালাবদলে। রাজনৈতিক ভাবে অতীত হয়েছিলেন বুদ্ধবাবু। তাই কি! বোধহয় নয়। তার পরেও বাংলার রাজনীতিতে ফিরে ফিরে এসেছেন তিনি। বলা যায়, যত দিন গড়িয়েছে রাজনৈতিক সচেতন বাঙালি তাঁকে পুনরাবিষ্কারই করেছে। তা করা জরুরিও বটে। বাংলার রাজনীতিতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্ভবত এমন পাঠ্য, যাঁকে ঠিক-ভুলের বাইনারিতে ফেলে দেওয়া সম্ভব নয়। বরং একটা নির্দিষ্ট পথের সন্ধানে যে-দ্বন্দ্ব, সেই দ্বন্দ্বের বাস্তবতাতেই বুঝে নিতে হয় তাঁকে এবং তাঁর রাজনীতিকে।
কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ- একদা এই স্লোগান স্বপ্ন হয়ে দেখা দিয়েছিল বাংলায়। ঘটনাচক্রে তাই-ই দীর্ঘ বামজমানায় পূর্ণচ্ছেদ টেনে দেয়। মাঝের এই পর্বটি বাঙালিকে আজও সেভাবে স্বস্তি দেয় না। এই এতদিন পরেও তা নিয়ে কথা উঠলে, ঠিক-ভুলের নানা মত নানা পথ পাশাপাশি চলতে শুরু করে। শিল্পভাবনার চিন্তা থেকে জমি অধিগ্রহণের বাস্তবতা, প্রশাসনের পদক্ষেপ থেকে পার্টিকেন্দ্রিকতা, প্রায় পাঠ্যবইয়ের মতোই উঠে আসতে থাকে নানা প্রসঙ্গ। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিরবধি সাফল্যের পথ পাননি। প্রশংসা-ভক্তিতে অবতারসুলভও হয়ে ওঠেননি। তিনি তুমুল সমালোচিত। তাঁর ভিতর সংকট আছে। আর, সংকট-সমালোচনা যে পরিসরে থাকে, সেখান থেকে আগামীর পথের সন্ধান আরও স্পষ্ট আলোকনির্দেশ পায়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঠিক এই জায়গাতে দাঁড়িয়েই বাংলার রাজনীতিতে একেবারে স্বতন্ত্র এক অধ্যায়।
সংস্কারের পক্ষপাতী ছিলেন বুদ্ধদেব। অনেকের কাছেই তিনি একজন স্বপ্ন-দেখা মানুষ। বুদ্ধদেবের এই ‘স্বপ্ন’ নিছক আকাশকুসুম কল্পনা নয়। ভাববাদের স্বপ্ন তাঁর নয়। বরং মার্কসবাদের পথ ধরেই তিনি স্বপ্নসন্ধানী। একটা নির্দিষ্ট বাস্তবতা যে-পথ স্থির করে দেয়, সেই পথই তিনি বেছে নিতে চেয়েছিলেন। মার্কসবাদ পদ্ধতি না প্রণালী, তা নিয়ে তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা আছে বিস্তর। তবে, সার কথা একটিই, পথের সন্ধান। সে-কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন লেনিন-ও। ১৯২১ সাল। কমিন্টার্নের তৃতীয় কংগ্রেসের প্রস্তুতি চলছে তখন। ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের উপর নানা কারণে বামপন্থীরা খড়্গহস্ত। আক্রমণের তত্ত্ব যে জোরদার হচ্ছে, লেনিনের তা অজানা ছিল না। সেই প্রেক্ষিতেই তিনি জানিয়েছিলেন, শুধু যে দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদী ভ্রান্তিই আছে, তা নয়। বামপন্থীদের ভ্রান্তির অস্তিত্বও আছে। ফলত লেনিন বলছেন, একটি সিদ্ধান্তের ভুলের প্রেক্ষিত ধরে সমালোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু তার জন্য গোটা ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টিকে নির্বিচারে আক্রমণ করা যায় না। সেদিন লেনিন খুব স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছিলেন- ‘কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে কোন নীতি অনুসরণ করতে হবে, তা নির্ধারণ করার ক্ষমতার দ্বারাই মার্কসবাদ গঠিত।’
নীতি নির্ধারণের এই পথ নিয়ে বহুবার সংকট দেখা দিয়েছে পরবর্তী সময়ে। তবে, যাঁরা ওই স্বপ্ন-দেখা মানুষ তাঁরা পরিস্থিতি থেকেই পথের সন্ধান করেছেন। বুদ্ধদেব ভট্টচার্যের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন রাজনৈতিক কার্যাবলি এই পথ ধরেই হেঁটেছে। অনেক পরে তিনি যখন চিনের ব্যবস্থা খতিয়ে দেখছেন, লিখছেন তাঁর বই ‘স্বর্গের নিচে মহাবিশৃঙ্খলা’, তখন সেখানে লিখলেন, ‘যখন সিচুয়ানে দেঙের দেশের বাড়িতে গিয়েছি, শুনেছি একটা কথা, বেড়াল যে রঙেরই হোক ইঁদুর ধরতে পারলেই হল। ইঁদুর শস্য নষ্ট করে তাই সেই বেড়ালকেই চাই যে ইঁদুর মারতে পারে। বেড়াল সাদা কি কালো বড় ব্যাপার নয়।’ এই কথা জানিয়েই বুদ্ধবাবু নিজের মন্তব্যটুকু লিখছেন এইভাবে, ‘সমাজতন্ত্রের তৈরি করার কোনও মডেল নেই। একটা নির্দিষ্ট এলাকা ধরে মার্কসবাদ অনুধাবন করাই আসল বিষয়। সমাজতন্ত্রের অগ্রগতির বিভিন্ন স্তর আছে।’ আমরা খানিকটা অনুমান করতে পারি বুদ্ধবাবুর মার্কসবাদী পথের সন্ধান। মিলিয়ে দেখে নিতে পারি ১৯২১-এ দেওয়া লেনিনের পরামর্শের সঙ্গেও। কেন যে তিনি চিনকেই খুঁটিয়ে দেখছেন, তা জানাতে গিয়েও বলেছিলেন চিনের ইতিহাসের ঘূর্ণাবর্তটিকেই তিনি সবিস্তারে দেখতে চাইছেন। তাই বলছেন, ‘কোনও চরিত্রের পক্ষে বা বিপক্ষে আমি দাঁড়াইনি। যে বিষয়টি বাস্তবে প্রমাণিত সেটিই সত্য, শুধু তত্ত্বে নয়- এই মার্কসিয় ধারণাকেই আমি আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করেছি।’
এই ধারণাকে তিনি আজীবন তাঁর সমস্ত রাজনৈতিক কাজকর্মেই আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করেছেন। রাজনীতি ভ্রান্তিহীন নয়। রাজনৈতিক নেতারও তাই ভুল হয় না, এমন নয়। বুদ্ধবাবুর ভ্রান্তি নেই এমন কোনও কথা নেই। তবে, রাজ্যের উদ্ভূত এক বাস্তবতা থেকেই তিনি নতুন একটা পথের সন্ধান করেছিলেন। তাঁর মার্কসবাদী বীক্ষাই তাঁকে এগিয়ে দিয়েছিল সেই রাস্তায়। তা ঠিক না ভুল, বিচারের ভার মহাকালের। তবে, এ কথা ঠিক, বাঙালির বুদ্ধ-চর্চা কাঁটাহীন নয়। তা বাঙালিকে সংকটের মুখে ফেলেছে, দ্বিধা-সংশয়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। আবার দৃষ্টি প্রসারিত করতে শিখিয়েছে আগামীতে। লাল নিশানের সরে যাওয়া বহু বাঙালির বুকে পাকাপাকি ক্ষতচিহ্ন। বুদ্ধবাবুর উপর অভিমান তাই কম নয়। আজও, অনেকেরই। কিন্তু এই সবকিছু মিলেমিশেই তিনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এক জলজ্যান্ত দ্বন্দ্ব। এক অবশ্যপাঠ্য বাস্তব অধ্যায়।
আজ সেদিকে তাকিয়ে, স্বীকার-অস্বীকার পেরিয়ে হয়তো বাঙালির হাতে থেকে গেল খানিক মনখারাপ-ও।