বাংলা ভাগ হয়ে দুই। ইলিশও। পদ্মার এবং গঙ্গার। তারও আবার অনেক ভাগ। মোদ্দা ভাগ একটাই, ঘটি ভার্সেস বাঙাল। ইলিশের দখলদারি কার? মিঠে দ্বন্দ্ব। মন্দ নয়! মনে করালেন বিশ্বদীপ দে।
রাধাপ্রসাদ গুপ্তর লেখায় রয়েছে, ‘দুনিয়াদারির খবর যাঁরা রাখেন তাঁরা জানেন যে একজন ইংরেজ বা জাপানি দিনে গড়পড়তা যত মাছ খায় বাঙালিরা তার সামান্য অংশও খায় না বা খেতে পায় না।’ এর কারণ আর কিছুই নয়, দারিদ্র্য। তবু ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে দেখা লাখ টাকার স্বপ্নের মতো সব আর্থসামাজিক শ্রেণির বাঙালির শয়নে স্বপনে জাগরণেই রয়ে গিয়েছে মাছের আঁশটে সুবাস! ছোটবেলায় ছড়া আওড়ানোর সময় চাঁদকে আমরা কথা দিয়ে ফেলি মাছ কাটলে মুড়ো দেওয়ার!
মঙ্গলকাব্য থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মাছের অনুষঙ্গ এসেছে বারংবার। ওই রাধাপ্রসাদের লেখাতেই রয়েছে, জোলা মরে তাঁতে। বাঙালি কাঙালি মরে মাছে আর ভাতে। তা সেই মাছের তালিকায় কত নামই তো আছে। তবু রুই-কাতলা-মৃগেল-পুঁটি-ট্যাংড়া যতই বাঙালির পাতে নিত্যদিন ভেসে বেড়াক, শেষ পর্যন্ত ইলিশের আবেদন সংশয়াতীত। ‘জলের রুপোলি শস্য’ই যে মাছে-ভাতে বাঙালির হৃদয়ের রাজমুকুট মাথায় পরে রেখেছে তা নিয়ে তর্ক বোধহয় হবে না। এমনিতেও ইলিশকে ভাঙলে পাব ইল ও ঈশ। ইল অর্থে জলে নামা ও ঈশ অর্থে ঈশ্বর। সুতরাং, রবীন্দ্রনাথ ইলিশের চেয়ে চিতল মাছের পেটিতে বেশি মুগ্ধ হলেও নামেই তো ইলিশকে আমরা জলের রাজা বানিয়ে দিয়েছি। কিন্তু বাঙালি কবে আর কোন তর্কে সম্পূর্ণ একমত হয়েছে! তাই এক্ষেত্রে তর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে অন্য। মাছের মধ্যে সেরা না হয় ইলিশ। কিন্তু সেরা ইলিশ কোনটা? পদ্মার নাকি গঙ্গার?
দিগেন বর্মনের ‘ইলিশ পুরাণে’ রয়েছে পদ্মার ইলিশ নাকি তিন প্রকার। পদ্ম ইলিশ, চন্দনা ইলিশ ও গুর্তা ইলিশ। অন্যদিকে গঙ্গার ইলিশ দুরকম। খোকা ইলিশ ও ইলিশ। দুই নদীর ইলিশের চেহারার বৈসাদৃশ্য হল গঙ্গার ইলিশের গায়ে সোনালি আভা ও পদ্মার ইলিশের গায়ে গোলাপি আভা। স্বাদেও ফারাক। আসলে জল অনুযায়ী বদলে যায় স্বাদ। মৎস্যবিজ্ঞানীরা বলেন, যে ইলিশ যত বেশি পথ পাড়ি দেয়, তার স্বাদ তত বেশি। গঙ্গা বা পদ্মা, কোন নদীর মাছ কত দূর যায় সেসব শুকনো তথ্য ঘেঁটে লাভ নেই। চায়ের টেবিলে ঝড় উঠলে পরিসংখ্যানের পাতা ফড়ফড়িয়ে উড়ে যায়। কে ওসব নিয়ে মাথা ঘামায়। এই তর্কের গভীরে আসলে রয়েছে যে রয়েছে এক মিঠে খুনসুটি।
সাইজে সেই অর্থে পদ্মা-গঙ্গার ইলিশে পার্থক্য নেই। তফাত কেবল স্বাদেই। বলা হয়, গঙ্গার ইলিশে তেল পদ্মার চেয়ে অনেক কম। তাই স্বাস্থ্যের পক্ষে এপার বাংলার ইলিশই সেরা। আবার পদ্মার ইলিশে স্বাদের জোর নাকি বেশি। তবে শেষপর্যন্ত এর অভ্যন্তরে রয়ে গিয়েছে অন্য ব্যাঞ্জনা। যে যেখানকার বাসিন্দা, সে তার হয়েই গলা ফাটাবে এতে আর আশ্চর্য কী? তবে সব সময় সেই নিয়মই বা খাটে কই? বুদ্ধদেব বসুর লেখায় রয়েছে, ‘পইঠায় বসে ধোঁয়া-ওঠা ভাত, / টাটকা ইলিশ-ভাজা/ ছোকানু রে, তুই আকাশের রানী/ আমি পদ্মার রাজা।’ কলকাতায় বসেও তাঁর হৃদয়ে ভেসে ওঠে পদ্মার ইলিশই। এদিকে সাহিত্যিক শংকরের লেখায় আবার একেবারে অন্য এক দাবি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক শেফের উদ্ধৃতি পাই। যেখানে তিনি বলেছিলেন, সেরা স্বাদ নাকি টাইগ্রিস নদীর ইলিশের!
আবার কমলকুমার মজুমদারের মতে, ”গঙ্গার ইলিশ দুশো বছর ধরে কোম্পানির তেল খেয়েছে। এই ইলিশের সাথে অন্য ইলিশ পাল্লা দেবে কী করে?” নেহাতই মজা করে বলা। কিন্তু এহেন মেধাবী রসিকতার আড়ালে বঙ্গীয় মৎস্যপ্রীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ইতিহাসপ্রজ্ঞা ঝলসে ওঠে। আলো পড়ে খাদ্য সংস্কৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থানের নিবিড় সহাবস্থানে। সেই হিসেবে দেখলে পদ্মার ইলিশে কি লেগে নেই দেশভাগের যন্ত্রণার করুণ স্পর্শ! দুই বাংলার বিচ্ছেদের সাক্ষী হয়ে ইলিশও বুঝি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। তবু ইলিশ নিয়ে এই তর্কে আসলে রয়েছে এক অন্যতর সংহতি। স্বাদের ভিন্নতায় অভিন্ন ইলিশপ্রীতি আসলে বাঙালির ভালোবাসার এক অনন্য একক হয়ে রয়ে গিয়েছে। কাঁটাতার সেখানে ভাগ বসাতে পারেনি।