প্যারিসে পদক এল না বটে। কিন্তু বিনেশ তো হারতে শেখেননি। মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে। তাঁর ধর্ম তিনি পালন করবেন। আর সেই ধর্ম পালনে আগামী দিনে রাষ্ট্র পাশে না থাকলেও দেশ তাঁকে আপন করে নেবে। যেমন নিয়েছে সবসময়। লিখলেন সুলয়া সিংহ।
বছরখানেক আগের সেই দিনটা। দেশে সোনার ন্যায়দণ্ড প্রতিষ্ঠার দিন ভূলুণ্ঠিত হয়েছিল দেশের সোনার মেয়েদের সম্মান। যৌন হেনস্তার বিরুদ্ধে বিচার চেয়ে জুটেছিল কেবলই নিপীড়ন, পুলিশের লাঠি। যন্তরমন্তর থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করা হয়েছিল বিনেশ ফোগট ও তাঁর সতীর্থদের। রাজনীতির বিষে বিষাক্ত হয়েছিল রাজধানীর আকাশ। অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার চিৎকারকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছিল সেদিন। প্রকাশ্যে, নির্মমভাবে, অকাতরে। কিন্তু চিরায়ত নিয়মে সময়ের চাকা যে ঘুরতেই থাকে। আর সেই চাকা ঘুরিয়ে দেখালেন বিনেশও। হাজারও যন্ত্রণা, অপমান, বঞ্চনার সামনে মাথা নত করেননি তিনি। উলটে এই অসম্মানকেই করেছেন হাতিয়ার। বদলার ধিকি ধিকি আগুন বুকের মাঝে জ্বালিয়ে রেখে প্রতিনিয়ত সঠিক মঞ্চের অপেক্ষা করেছেন। শেষমেশ প্যারিস অলিম্পিকের রিংয়ে ঘটেছে সেই অগ্ন্যুৎপাত।
বিনেশের পরিশ্রমের ঘাম, লাঞ্ছনার হতাশা, ঘুরে দাঁড়ানোর খিদে পদে পদে টের পেয়েছেন বিপক্ষরা। ভারতের সোনার মেয়ে অবশ্য ভাবেননি প্রতিপক্ষ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন কি না! তাঁর কাছে যেন প্রতিটা বাউটই ছিল নিজেকে প্রমাণ করার লড়াই। রাষ্ট্রের চোখরাঙানির বিরুদ্ধে জবাবের লড়াই। যৌন হেনস্তার অভিযোগ তোলায় যাকে শুনতে হয়েছে, ঠিক কীভাবে হয়েছিল প্রমাণ করুন, তাঁদের গালে সপাটে চড় মারার লড়াই। বিনেশের কাছে প্রত্যেকটা বাউটই যেন ছিল ব্রিজভূষণ শরণ সিংকে মাটি ধরানোর লড়াই। আর একের পর এক লড়াই জিতে তিনি সেই লড়াইয়েরই চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেমিফাইনালে যখন ইউক্রেনের প্রতিপক্ষকে হারিয়ে মাথা তুলে হাসলেন, সেই হাসিতে আনন্দের সঙ্গে মিশেছিল অনেক কিছু। নিজেকে প্রমাণের তৃপ্তি। অপমানের জবাব দেওয়ার স্বস্তি। কোনও অপরাধ না করেও একবছর আগে যাঁকে পুলিশের লাঠিপেটা সহ্য করতে হয়েছিল, এদিন তাঁর হাসি যেন বলে দিচ্ছিল, মাথা তুলব এমন, চোখ তুলে তাকাতেও লজ্জা পাবি। পারলেন, তিনি পারলেন। ফিনিক্স পাখির মতোই প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস রচনা করে দারুণ অগ্নিবাণে জ্বালিয়ে দিতে পারলেন ক্ষমতায় আসীন দাম্ভিকদের। The best revenge is massive success. -ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রার এ কথাকেই বাস্তবে রূপ দিলেন বিনেশ। অলিম্পিকের রিংয়েই সম্পন্ন হল তাঁর লড়াইয়ের বৃত্ত। অহিংস, শান্তির প্রতিশোধে যেন সমৃদ্ধ হল কবিতার দেশও। বিনেশের সাফল্যের হাসি তৃপ্তি দিল গোটা ভারতর্ষকেও।
কিন্তু বাস্তবটা বড়ই নির্দয় বিনেশ। দিনের শেষে আপনার নামের পাশে যে কোনও অলিম্পিক পদক থাকল না। ওজন বেশি হওয়ায় ফাইনালের মঞ্চে নামতে পারলেন না বলে। তাই দুদিন পর এই মাতামাতি ফের ফিকে হবে। নানা রোমাঞ্চকর ঘটনায় গা ভাসাবে দেশ। এখন যাঁরা আপনাকে দেশের গর্ব বলে দাবি করছেন, তাঁরা যে আবারও ক্ষমতার লাঠি উঁচিয়ে ধরবেন না, সে গ্যারান্টি কই? আমজনতার উপর রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু তো চিরন্তন সত্য। তাই বিনেশ, আপনার আর কিছু প্রমাণ করার দরকার নেই। দায়ও নেই। বেটি বাঁচাওয়ের জিগির তুলে যারা সোনার মেয়েদের উপর হেনস্তা দেখেও নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করে, তারা বিনেশ নামক অঘটন ঘটিয়ে ফেলা এক নক্ষত্রের মূল্য বুঝবে না। আপনি নিজের কাছে জিতে গিয়েছেন। জিতে নিয়েছেন সেই কোটি কোটি হৃদয়, যাঁরা আপনার জীবনযুদ্ধ দেখে নতুন করে বাঁচার স্বাদ পেয়েছেন। যাঁরা মাথা উঁচু করে বলবেন, “আমাদের একজন বিনেশ আছে।” তাঁরাই খোলা চোখেও ভালোভাবে দেখতে পাবে আপনার গলায় জ্বলজ্বল করছে অদৃশ্য স্বর্ণপদকটি।
ভিনদেশের পরিবারের দৃঢ় বিশ্বাস, আবারও নিজেকে উজাড় করে দিয়ে দেশের জন্য পদক আনবেন তিনি। হ্যাঁ, দেশবাসীরও তেমনই বিশ্বাস। কারণ তিনি তো হারতে শেখেননি। মাঠ কিংবা মাঠের বাইরে। তাঁর ধর্ম তিনি পালন করবেন। আর সেই ধর্ম পালনে আগামী দিনে রাষ্ট্র পাশে না থাকলেও দেশ তাঁকে আপন করে নেবে। যেমন নিয়েছে সবসময়। বিনেশ, আপনাকে ধন্যবাদ। যন্ত্রণা ভুলে স্বপ্ন দেখাতে শেখানোর জন্য। বিনেশ, আপনি শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।