১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট। এক ভয়ংকর বোমা বিস্ফোরণে পৃথিবী থেকে মুছে গিয়েছিল হিরোশিমা নামের একটা শহর। চোখের নিমেষে প্রাণ হারিয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ।
৬ আগস্ট, ১৯৪৫। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহ হিরোশিমা জুড়ে। তার মধ্যেই নতুন একটা দিন। একটু একটু করে জেগে উঠেছে শহর। ঘড়ির কাঁটা সকাল আটটা পেরিয়ে মিনিট পনেরো গড়িয়েছে। হিরোশিমার সুমিতোমো ব্যাঙ্কের সামনে সিঁড়িতে বসেছিলেন এক মহিলা। এসেছিলেন ব্যাঙ্কের কাজে। হয়তো সিঁড়িতে বসে কাগজপত্রে প্রয়োজনীয় কিছু লিখে নিচ্ছিলেন। তখন কি আর তিনি জানতেন, তাঁর আয়ু আর মাত্র কয়েক লহমা!
আরও শুনুন:
হিরোশিমা বিস্ফোরণের জেরে মৃত্যু ১০ বছর পর, যুদ্ধের পালটা শান্তির প্রতীক সেই কিশোরী
মার্কিন যুদ্ধবিমান থেকে ঠিক ওই আটটা পনেরোতেই হিরোশিমার বুকে পড়েছিল পারমাণবিক বোমা। সিঁড়িতে বসে থাকা মহিলা মিলিয়ে গেলেন মুহূর্তে। তিনি একা নন, প্রায় আশি হাজার মানুষ মুহূর্তে ‘নেই’ হয়ে গিয়েছিলেন বিস্ফোরণের তীব্রতায়। শুধু ওই সিঁড়িতে বসা মানুষটির ছায়া থেকে গেল চিরতরে। পাথরের বুকে চিরকালের জন্য খোদাই হয়ে থেকে গেল সভ্যতার লজ্জা হয়ে। এরকম আরও ছায়ার ছবি থেকে গেল হিরোশিমার বুকে, যেদিকে চোখ পড়লে আজও শিউরে ওঠে মানুষ।
কেন ওই ছায়ার ছবিটি পাথরে থেকে গিয়েছিল, তা নিয়ে পরে অনেক কথাবার্তা হয়েছে। মনে করা হয়, বিস্ফোরণের সময় ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ছিল ৩০০০ থেকে ৪০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপে মানুষের শরীর স্রেফ বাষ্পীভূত হয়ে উবে গিয়েছে। শুধু শরীরটি যে ছিল, সেই চিহ্ন হিসাবেই কালো ছায়াটুকু রয়ে গিয়েছে। এ নিয়ে অন্য মতও আছে। বলা হয়, সেই তাপমাত্রায় মানুষের শরীরের অন্যান্য অংশ উবে গেলেও হাড়গোড় ইত্যাদি থেকে গিয়েছিল। তাই-ই হয়তো পিণ্ডের মতো তালগোল পাকিয়ে কোনক্রমে ছিল। বিকিরণের দরুণ সিঁড়ির পাথরের অন্যান্য অংশ স্বাভাবিক রং হারায়। শুধু ওই অংশটিতে বজায় থাকে আগেকার রং বা কালো রং। যা মানুষের দেহের আকৃতির মতোই হয়ে থেকে যায়। আর তাই মানুষের ছায়া হিসাবে তা পরিগণিত। কারণ যা-ই হোক না কেন, আসল কথা হল, এল লহমা আগেও মানুষটি ছিলেন। মুহূর্তে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। সেই মুহূর্তটিই ধরা আছে ওই ছায়ার ভিতর। অনেককাল সেই ছায়ার ছবি ঘিরে রাখা ছিল। পরে ১৯৭০-এর দশকে তা সরিয়ে নিয়ে গিয়ে রাখা হয় হিরোশিমা পিস মিউজিয়ামে। চাইলে আজও তা দেখা যায়। যুদ্ধের ভয়াবহতা যে শুধু কথার কথা নয়, সেই নৃশংশতা স্মরণ করতেই এ ছবির গুরুত্ব আগামী পৃথিবীতে।
:আরও শুনুন:
এক রাতেই মৃত্যু অন্তত ১ লক্ষ মানুষের, এই বিমান হামলা হার মানায় হিরোশিমাকেও
তা বলে কি যুদ্ধ থেমে গিয়েছে? তা নয়। আজও পৃথিবীর নানা প্রান্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত। একই ক্ষতি, একই ক্ষয়, একই বিপর্যয়। তবু তার মধ্যেও ফিরে ফিরে আসে এই ছায়ার ছবি। সেদিনের সেই হিংস্র অমানবিক মুহূর্তটিকে মনে করা আমাদের কর্তব্য। এই মুহূর্তই আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এর পুনরাবৃত্তি যেন আর না হয়। যেমন মনে করতে হয় হিরোশিমার মেয়ে সাদাকো-র গল্পও। সেদিন সেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণের অভিঘাতে যখন জানলার বাইরে ছিটকে পড়েছিল সেদিনের ছোট্ট মেয়েটি, দিশাহারার মতো ছুটে গিয়েছিলেন মা। ধরেই নিয়েছিলেন, মেয়ের মৃতদেহই কুড়িয়ে আনতে হবে তাঁকে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, মেয়ের কাছে পৌঁছে তিনি দেখেছিলেন তার গায়ে আঁচড়টুকু লাগেনি। যদিও যুদ্ধ তাকে রেহাই দেয়নি। অ্যাকিউট ম্যালিগন্যান্ট লিম্ফ গ্ল্যান্ড লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিল সাদাকো সাসাকি নামের সেই জাপানি মেয়েটি। জাপানের বাসিন্দাদের কাছে সেইসময় এর পরিচিতি ছিল ‘অ্যাটমিক বম্ব ডিজিজ’ নামে। মাত্র বারো বছরেই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিতে হয়েছিল সাদাকো-কে। তছনছ হয়ে গিয়েছিল বহু শিশুর জীবন। পরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শান্তির প্রতীক হয়ে উঠেছিল এই কিশোরী। হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্কে আছে সোনার সারস হাতে সাদাকোর মূর্তি। তলায় লেখা, “এই আমাদের কান্না। এই আমাদের প্রার্থনা। পৃথিবীতে শান্তি আসুক।”
পৃথিবীতে শান্তি কবে নেমে আসবে আমাদের জানা নেই। তবে সভ্যতার বিপর্যয়ের দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রার্থনা একটাই, সাগর ডিঙিয়ে আর যেন কেউ বোমা না ফেলে আসে! এমন বীরপুরুষের বেশ কাম্য নয় পৃথিবীর।