ছ’বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে হার মানতে হয়েছিল মনের দৈত্যের কাছে। টোকিও অলিম্পিক্স থেকে চোখের জলে বিদায় নিয়েছিলেন সিমোন বাইলস। এবার সেই দৈত্যের সঙ্গে লড়াই করতেই প্যারিসে ফের ডানা মেললেন তিনি।
ছ’বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নের জীবনের সব দরজা রুখে দিয়েছিল মনের দৈত্য। খেলার মঞ্চ দেখলেই পালাতে ইচ্ছে হত। প্রবল খ্যাতির অভ্যাস, অথচ লোকের ভিড় দেখলেই ঢেকে ফেলতে হত মুখ। সেই দৈত্যের সঙ্গে লড়াই করে, লড়াই করতে করতে এবার প্যারিস অলিম্পিক্সের মঞ্চে উড়াল দিয়েছেন আমেরিকার জিমন্যাস্ট সিমোন বাইলস। আর তাঁর এই ফিরে আসার নামেই অলিম্পিক্সের বইয়ে লেখা হয়ে গিয়েছে নতুন রূপকথা।
:আরও শুনুন:
গর্ভে ৭ মাসের সন্তান, তবু অলিম্পিকে লড়ে কুর্নিশ আদায় হবু মায়ের
‘মন ভালো নেই’, এ কথা নিয়ে আমরা মিম বানাই। হাসিঠাট্টাও করি কখনও বা। ছুড়ে দিই ব্যঙ্গের তির। কিন্তু ভুলে যাই, মানুষের মন বড় আশ্চর্য জিনিস। সে জোর দেয়, আবার জোর কেড়েও নেয়। দৈত্যের মতো কখন কেড়েকুড়ে নিয়ে যায় সমস্ত প্রাণশক্তি। কিন্তু সেই শূন্য হয়ে যাওয়াকে তো বাইরে থেকে দেখা যায় না। তাই মন ভালো নেই বলে থমকে যাওয়া মানুষকে আমরা চিনতে পারি না। তার উপরে সে মানুষের নামে যদি অসম্ভব সাফল্যের ঠিকানা লেখা থাকে? তবে তো তাঁর থমকে যাওয়াই মানা। অথচ মনের দৈত্য তো হানা দিতে পারে যার তার ঘরেই। রাজার দুঃখ দেখে গুপী-বাঘার সেই গান মনে পড়ে, “দুঃখ কিসে হয়?/ অভাগার অভাবে জেনো শুধু নয়।” তবুও, কোনও সফল মানুষের আবার দুঃখ হয় নাকি, এমনটাই ভাবি আমরা। মনে পড়ে, অলিম্পিক্সের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল ক্রীড়াবিদ, ২৩টি সোনা জেতা কিংবদন্তি সাঁতারু মাইকেল ফেল্পস বলেছিলেন, “আমাদের দুর্বলতা থাকতে নেই। থাকলেও তা দেখাতে নেই।” আসলে সমাজ তো এমনটাই শিখিয়ে দেয়। কোনও সফল মানুষের মনখারাপ হতে নেই, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-রাগে-ক্ষোভে এ কথাই বলে দেওয়া হয়।
সিমোন বাইলস সে কথা মানেননি। মেনেছিলেন, অন্তত চেষ্টা করেছিলেন অনেকদিন। ছ’বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন তিনি। সব প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঊর্ধ্বে নিয়ে গিয়েছেন নিজেকে। তাঁর উপর পাহাড়প্রমাণ প্রত্যাশা। প্রতিটি বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে, অলিম্পিক্সের আসরে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রত্যাশার প্রহর গোনে দেশ। তিনি কি বলতে পারেন, আজকে আমার মন ভালো নেই? এত পদক, এত টাকা, এত খ্যাতি- তিনি এ কথা বললে প্রত্যেকে তো হেসেই উড়িয়ে দেবে। কিন্তু একসময় আর পারলেন না। ২০১৬ সালে চারটি সোনা জেতা সিমোন, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ১৯টি সোনা-সহ ২৫টি পদক জেতা সিমোন, পাঁচ বছর ধরে টোকিও অলিম্পিক্সের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে যাওয়া সিমোন –
হেরে গেলেন।
‘আমানার’ ভল্ট দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টার পর বুঝলেন, শরীর তাঁর কথা শুনছে না। মন কোনও কথা বলতেই চাইছে না শরীরকে। বাইলস আসলে এমন এক মনের রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, যেখানে যে কোনও মুহূর্তে মন মাথা পুরোপুরি ফাঁকা মনে হতে পারে। শূন্যে শরীর ছুড়ে হেলিকপ্টারের ডানার মতো পাক খেতে খেতে নামার সময় যদি কারও মাথা কাজ না করে, কোন দিকে মাথা আর কোন দিকে পা তা-ই গুলিয়ে যায়, কী হতে পারে? সাফল্য, ব্যর্থতা তো অনেক পরের কথা। স্রেফ মরে যেতে পারতেন সিমোন। এই অবস্থায় তিনি ‘না’ বললেন। সেসময় আমেরিকার কিংবদন্তি জিমন্যাস্টের বয়স ২৪ বছর। কিন্তু অল্প বয়স বা বেশি সাফল্য, কোনটিই যে মনের অসুখ রুখতে পারে না, সে কথা সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সিমোন বাইলস।
:আরও শুনুন:
শুধু খেলা নয়, জীবনেও পিছু হটতে নারাজ! সাক্ষী-বিনেশদের পাশে দাঁড়াতে ভয় পাননি মনু ভাকের
সিমোন সেদিন বলেছিলেন, তাঁকে দেখে অনেকে ‘না’ বলার সাহস পাবে। এ কথাও সত্যি, তাঁকে দেখে অনেকে মনখারাপে ‘হ্যাঁ’ বলারও সাহস পাবে। মনের অসুখকে অস্বীকার করবে না, এড়িয়ে যাবে না। আর সিমোন মানে তো শুধু সেইটুকুই নয়। সিমোন মানে লড়াই। যিনি সমাজের সব আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে মনের দৈত্যের হানার কথা জানিয়েছেন, আবার সেই ভিতর ঘরের আক্রমণের সঙ্গে লড়ে ফিরতে চেয়েছেন তাঁর নিজের মাটিতে। পায়ের চোট নিয়েও প্যারিস অলিম্পিক্সের যোগ্যতা অর্জন পর্বে সেরা সিমোন, ইতিমধ্যেই দলগত ইভেন্টে জিতে নিয়েছেন প্রথম সোনাও। আর এই প্রত্যেকটা লড়াইয়ে তাঁর মাথায় অলিভ পাতার মুকুট পরিয়ে দিচ্ছে জীবন। নিজের মনের বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজা খুলতে খুলতে আমাদের সকলকে চিচিং ফাঁক মন্ত্র শিখিয়ে দিচ্ছেন আমেরিকার ‘কালো মেয়ে’।