রাতের জঙ্গলে বাঘিনি আর তার দুই সন্তানের মুখোমুখি। সেখান থেকেই বাঘকে ভয় না পেয়ে ভালোবাসতে শুরু করেছিলেন ‘শেরনি’। আন্তর্জাতিক বাঘ দিবসে শুনে নিন সেই নারীর কথাই।
বনজঙ্গলে মেয়েরা বেড়াতে যেতে পারেন বটে, কিন্তু বনের রাজার সঙ্গে মোকাবিলার দায়িত্বে থাকবেন কোনও মেয়ে? উঁহু। শক্তি আর সাহসের কাজ যে এখনও অনেকাংশেই পুরুষপ্রধান, সে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই কোনও ফরেস্ট অফিসার মহিলা হলে তাঁকে হালকা ভাবে নেওয়াটা অলিখিত দস্তুর। কিন্তু বাঘিনির মতোই সেই ছক ভেঙে জঙ্গল দাপিয়ে বেড়িয়েছেন এই নারী। আগলে রেখেছেন সে জঙ্গলের বাঘকেই। ‘শেরনি’-র তকমা তো তাঁকেই সাজে। তিনি, কাশীপালায়াম মহেশ্বরী অভর্ণা।
:আরও শুনুন:
শনিবার আমিষ জোটে না বাঘের কপালেও! কেন এমন নিয়ম চিড়িয়াখানায়?
হিন্দি ছবি ‘শেরনি’-র দৌলতে বিদ্যা বালানের চেহারায় তাঁকে চিনেছেন অনেকেই। ২০১৭-১৮ সালে মহারাষ্ট্রের জঙ্গলের বাঘিনি অবনী, আর তাঁকে ধাওয়া করে চলা তৎকালীন ডেপুটি কনজারভেটর অব ফরেস্ট অভর্ণাকে নিয়েই তৈরি হয়েছিল সে ছবি। তবে সেটাই অভর্ণার পরিচয় নয়। তাঁর আসল পরিচয় তৈরি করেছেন তিনি নিজের হাতেই, আর তা হিন্দি ছবির চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়।
আরও শুনুন:
অসম সাহস! সন্তানকে ফেরাতে বাঘের সঙ্গে লড়াই মায়ের
তামিলনাড়ুর ইরোডের গোবিচেট্টিপালায়ামের মেয়ে অভর্ণার পরিবারে তিনিই প্রথম আইএফএস। বাহ্যিক চেহারায় তাঁকে ডাকাবুকো কি খুব শক্তিশালী বলে হয়তো মনে হবে না। কিন্তু আসলে তো সাহস থাকে মানুষের বুকের মাঝে। তাই রাইফেল হাতে রাতের বনে টহল দিতে ভয় পাননি অভর্ণা। শিকার ঠেকাতে রাতের পর রাত বনরক্ষীদের সঙ্গে নিয়ে জঙ্গলে ওত পেতে থাকতেন তিনি। বিপদ ছিল বইকি। একবার ওয়াচ টাওয়ারে উঠে জঙ্গলের রাস্তায় সার্চলাইটের আলো ফেলতেই দেখেন বাঘ। তাও একটি নয়, তিন-তিনটি। দুই সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে শিকার ধরতে এসেছে মা বাঘিনি। এদিকে তাদের খুব কাছেই দাঁড়িয়ে গাড়ির চালক। কোনওমতে তাঁকে সতর্ক করে ছুটে এসে গাড়িতে ওঠেন অভর্ণা। তাতেই কি বাঘের হাত থেকে রেহাই মেলে! গাড়ির পিছনটা খোলা, ফলে রিভার্স গিয়ারে গাড়ি চালাচ্ছেন চালক, আর জিপসি লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে বাঘ। বনেটে এসে ঠেকছে তার থাবা। কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যানের কোহরা রেঞ্জে সে রাতে যে অভিজ্ঞতা ঘটেছিল, সেখান থেকেই বাঘকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন- এমনটাই মনে করেন অভর্ণা। ভয় নয়, বন্যপ্রাণ রক্ষার জন্য প্রাণপণ লড়াইয়ের জেদ তাঁকে শিখিয়ে দিয়েছিল সেই মা বাঘিনি।
:আরও শুনুন:
কারাগারেই জন্মাল বন্দিনীর সন্তান, উদযাপনে মাতল গোটা জেল
সেই সময়েই মহারাষ্ট্রের ইয়াভাতমালের জঙ্গল-গ্রামে আতঙ্ক ছড়ানো শুরু করেছে অবনী ওরফে টি-১। অসম থেকে মহারাষ্ট্রে বদলি হওয়ার পরে সেই বাঘিনিকে ধরার ভার পড়ে অভর্ণার ওপরে। তখন তিনি ডেপুটি কনজারভেটর অব ফরেস্ট। তাতে কী! অবনীকে গুলি করে মারার অনুমতি দেওয়া নিয়ে আমলাতন্ত্রে, রাজনীতির দুনিয়ায় দড়ি টানাটানি চলছে। সেখানে নারী অফিসারের বাঘ বাঁচানোর চেষ্টাকে ভালো চোখে দেখেননি কেউই। প্রিন্সিপাল চিফ কনজারভেটর অব ফরেস্টের কাছে লাগাতার অভিযোগ করেছেন বন দপ্তরের নিযুক্ত শিকারি। সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও শেরনির মতোই অভর্ণা ২০১৭-র অগস্ট থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত টি-১ বাঘিনিকে রক্ষা করেছেন। তাঁর রিপোর্টে অভর্ণা জানিয়েছিলেন, অবনীকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ঘুম পাড়ানো গুলিতে কাবু করা যেত, সে সুযোগ দুবার হাতছাড়া হয়েছে। শিকারির হাতে বাঘিনির মৃত্যু রুখতে শেষ পর্যন্ত লড়েছিলেন অভর্ণা।
তবে বাঘকেও তো কখনও কখনও হার মানতেই হয়। হেরে গিয়েছেন অভর্ণাও। তবে অবনীর দুই শাবককে তিনি বাঁচাতে পেরেছিলেন, এটুকুই সান্ত্বনা তাঁর। কোনও মহিলা বনকর্মী মাত্রেই যে গুরুত্বহীন নন, তাঁকেও সমঝে চলতে হয়, বন আর বন্যপ্রাণী ধ্বংস করতে চাওয়া মানুষদের সামনে বাঘের মতোই বুক চিতিয়ে সে বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন কাশীপালায়াম মহেশ্বরী অভর্ণা। জঙ্গলের শেরনি।