“তেলের শিশি ভাঙল বলে/ খুকুর পরে রাগ করো/ তোমরা যে সব ধেড়ে খোকা/ বাংলা ভেঙে ভাগ করো!/ তার বেলা?” সেই কবে এ প্রশ্ন তুলেছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়। দিন গড়িয়েছে, তবে বাংলা ভাঙার প্রস্তাব এখনও জারি। সম্প্রতি সেই প্রস্তাবের পক্ষেই একজোট বিজেপি। কিন্তু এ প্রস্তাব তো নতুন নয়। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
সম্প্রতি সংসদে দাঁড়িয়েই বাংলা ভাগের ধুয়ো তুলেছে বিজেপি। বাংলার মালদহ এবং মুর্শিদাবাদকে আলাদা করে তার সঙ্গে বিহারের তিন জেলা জুড়ে আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি হোক, দাবি ঝাড়খণ্ডের বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবের। আবার পৃথক কোচবিহার রাজ্যের দাবি জানিয়েছেন বিজেপি সাংসদ অনন্ত মহারাজও। এদিকে খোদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে উত্তরবঙ্গকে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে জোড়ার প্রস্তাব তাঁর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। সব মিলিয়ে নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে বঙ্গভঙ্গের দাবি। তার জেরে ইতিমধ্যেই বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে কথা হল, বাংলাকে ভাগ করার প্রস্তাব কিন্তু আদৌ নতুন নয়। স্বাধীনতার আগে থেকেই, আর স্বাধীনতার পরেও বারেবারে উসকে উঠেছে বঙ্গভঙ্গের দাবি। তার কারণ হিসাবে কখনও বাংলার জনবিন্যাসের কথা বলা হয়েছে, কখনও আবার ভাষা, সংস্কৃতি, কিংবা ধর্মের ফারাকের কথা টেনে বিভাজনের দাগ পড়েছে, আর এসবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছে রাজনৈতিক স্বার্থ।
আরও শুনুন:
ভাষার লড়াই থেকে শাহবাগ, আন্দোলনের পথে এগিয়েছে যে বাংলাদেশ…
এ দেশে যখন ব্রিটিশ আমল শুরু হয়, সেসময় বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা একসঙ্গে জুড়েই ছিল বঙ্গদেশ। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে সরিয়ে এই বিপুল অঞ্চলের রাজস্ব এবং সম্পদে থাবা বসিয়েছিল ইংরেজ শাসকেরা। কিন্তু ক্ষমতাকে উপভোগ করলেও, দায়িত্ব নেওয়ার মনোভাব ছিল না তাদের। ফলে অবাধ লুণ্ঠন আর অরাজকতায় বঙ্গ জুড়ে বারেবারে নেমে আসছিল দুর্ভিক্ষের ছায়া। ১৮৬৬ সালে উড়িষ্যায় একটা বড় দুর্ভিক্ষ হয়। তখন উড়িষ্যা, বিহার, আসাম- সবই ছিল ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির প্রশাসনিক এলাকার মধ্যে। উড়িষ্যার সেই দুর্ভিক্ষের পরেই শাসনকার্যের সুবিধের জন্য এত বড় প্রশাসনিক এলাকাকে ভাঙার ভাবনা শুরু। সম্ভবত স্যার স্ট্যাফোর্ড নর্থকোট-এর প্রস্তাবমতোই প্রথম প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের মুখে পড়ে বাংলা। ১৮৭৪ সালে আলাদা হয় অসম, তার সঙ্গেই জুড়ে দেওয়া হয় বাংলাভাষীদের সিলেট এলাকা। এরপরেও দক্ষিণ লুসাই পাহাড়, নোয়াখালি সহ চট্টগ্রাম ডিভিশন, এমনকি ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকেও আসামের অন্তর্ভুক্ত করার কথা উঠেছিল। তবে অসমের কমিশনার স্যার হেনরি কটন ঢাকা ও ময়মনসিংহকে জোড়ার এই প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছিলেন।
কিন্তু ১৯০১ সালে সেন্ট্রাল প্রভিন্স-এর চিফ কমিশনার অ্যান্ড্রু ফ্রেজার যখন বাংলা ও সেন্ট্রাল প্রভিন্সের এলাকার পুনর্বিন্যাস চাইলেন, তখন নড়েচড়ে বসলেন খোদ ভারতের বড়লাট লর্ড কার্জন। ১৯০৩ সালের ২৮ মার্চ ফ্রেজার বড়লাটের কাছে প্রস্তাব পাঠান সমগ্র চট্টগ্রাম ডিভিশান, ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য। কেবল প্রশাসনিক সুবিধে নয়, রাজনৈতিক লাভের কথাও তিনি বড়লাটকে বুঝিয়ে দেন ভালোভাবেই। শুরু হয় বাংলা ভাগের পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা। রংপুর, বোগরা, পাবনাকেও আসামের সঙ্গে যুক্ত করার কথা বলা হয়। তালিকায় যুক্ত হয় রাজশাহি, দিনাজপুর, মালদহ, জলপাইগুড়ি, কোচবিহারও। অবশেষে ১৯০৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর বঙ্গভঙ্গের ঘোষণা করে সরকার। নতুন প্রদেশের নাম দেওয়া হয় ‘পূর্ব বাংলা ও আসাম’। ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ প্রশাসনিকভাবে কার্যকর করা হয়।
প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের পাশাপাশি বাংলার জাতীয়তাবাদী সংগ্রামকে ভেঙে দিতেই এই পদক্ষেপ নিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু তার জেরে বাংলায় যে বড় আন্দোলন ঘনিয়ে ওঠে, স্বদেশী ও বয়কটের ঢেউ জাগে, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের রাখিবন্ধন যেভাবে সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখেছিল সরকার। ফলে সেই সময়ের মতো বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে যায়, যদিও বদলে যায় দেশের রাজধানী।
আরও শুনুন:
স্মরণে দেশভাগ: স্মৃতি ও সংকটকে মুখোমুখি বসিয়ে নতুন পথের সন্ধান
সময় বদলায়, বদলায় রাজনীতির দিনকাল। স্বাধীনতার ঠিক আগে আগে যখন ফের বঙ্গভঙ্গের ধুয়ো ওঠে, তখন তার বিরুদ্ধে আর আগের মতো জোট বাঁধেনি বাঙালি। একদিকে মুসলিম লিগের হাত ধরে দ্বিজাতি তত্ত্ব আর মুসলিমদের জন্য আলাদা দেশের দাবি উঠছিল। অন্যদিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলিম লিগের বড় দল হয়ে ওঠা মেনে নিতে পারছিল না হিন্দুদের একাংশ। তারাও চাইছিল নিজেদের আলাদা প্রদেশ। শরৎ বসু, সুরাবর্দি ও কিরণশংকর রায়ের সঙ্গে মিলে যুক্ত বাংলার প্রস্তাব দিলেও বাংলা কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতা তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। শোনা যায়, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়ে বাংলাভাগের আর্জি জানিয়েছিলেন সেসময়ের বহু বাঙালি বুদ্ধিজীবী। দেশভাগ হলে তফশিলি সম্প্রদায়কে পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যেতে বলেন তাদের নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, আবার আরেক তফশিলি নেতা প্রমথ রঞ্জন ঠাকুর তাদের হিন্দুপ্রধান এপার বাংলায় থাকার কথা বলেন। ততদিনে হিন্দু মহাসভার আধিপত্যও বাড়ছিল। দেশভাগ এবং সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাভাগের অন্যতম প্রবক্তা হয়ে দাঁড়ান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা ও দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গেই অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায় বাংলার বিভাজন।
সেই ভাগাভাগির জেরে ভিটেমাটি হারিয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। এপার বাংলা ও ওপার বাংলা দুদিকেই ক্ষতি হয়েছিল অনেকখানি। তারপরেও ফের মাথাচাড়া দিচ্ছে বাংলা ভাগের দাবি। বাংলায় গোর্খাল্যান্ড, কামতাপুরি, গ্রেটার কোচবিহারের দাবি বারেবারেই তুলেছে বিভিন্ন গোষ্ঠী। সেইসঙ্গে এবার যুক্ত হল নিশিকান্তের কেন্দ্রীয়শাসিত অঞ্চল গড়ার নতুন প্রস্তাব। রাজনীতির জল এবার কোনদিকে গড়াবে, সেটাই এখন দেখার।