কোনও শিল্প অপছন্দ হলেই আক্রমণের তির ধেয়ে যায় শিল্পীর দিকে। শিল্পের সমালোচনা হয়ে ওঠে শিল্পীকে কাটাছেঁড়ার অজুহাত। এই প্রবণতা কি কেবল সমকালের? উঁহু। কোন কালেই বাঙালির শিল্প সমালোচনায় এই পরনিন্দার আসরটি খুলে দিয়েছিল ‘শনিবারের চিঠি’। বিখ্যাত পত্রিকাটির শতবর্ষে শুনে নেওয়া যাক সে কথা।
চায়ের আড্ডা থেকে সাহিত্যের বৈঠক, পরনিন্দা বাঙালিকে ছাড়ে না। কিংবা বাঙালি ছাড়ে না পরনিন্দার অভ্যাস। তার গুণ কম নেই, শখেরও কমতি নেই, তবুও পরনিন্দা আর পরচর্চাতেই বুঝি তার প্রাণের আরাম আর মনের শান্তি মেলে সবচেয়ে বেশি। হয়তো সেই কারণেই, তার জীবনের সর্ব ক্ষেত্রেই ওই অভ্যাস উঁকি দিয়ে যায়। নিজেকে সংস্কৃতিমনস্ক ভাবতে ভালোবাসে যে বাঙালি, তার সংস্কৃতিচর্চাতেও জড়িয়ে যায় ওই প্রবণতা। তার ফলে বাঙালির সাংস্কৃতিক সমালোচনায় অনেকসময়েই আসর জাঁকিয়ে বসে নিন্দার ঢক্কানিনাদ। কোনও শিল্প সাহিত্য অপছন্দ হলেই শিল্পীর প্রতি ঝাঁঝালো আক্রমণ শানানো শুরু হয়ে যায়। কী ভাবছেন, এ প্রবণতা কেবল সমকালের দান? আজ্ঞে না। বাঙালির এই প্রবণতাকে যথাযথ সার জল দিয়ে যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কেউ পথ দেখিয়ে থাকে, তবে তার দায় বর্তায় একটি পত্রিকার উপর। তার নাম শনিবারের চিঠি।
১৯২৪ সালে প্রকাশিত এই পত্রিকা রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুল থেকে জীবনানন্দ, কাউকেই রেয়াত করেনি। এমনিতে সাহিত্যের সমালোচনা সেকালে সাহিত্যের অপরিহার্য অঙ্গ ছিল, বঙ্কিমচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথরাও পুরনো বা নতুন সাহিত্য নিয়ে ক্ষুরধার আলোচনা করেছেন। কিন্তু শনিবারের চিঠি সমালোচনার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল তীব্র ব্যক্তি আক্রমণে। লেখা নিয়ে প্যারডি করা, লেখকের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের প্রতি কটাক্ষ, কোনও কিছুই বাদ যেত না সেখানে।
যেমন ধরা যাক, রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘ভারত ভাগ্যবিধাতা’, অর্থাৎ ‘জনগণ-মন অধিনায়ক জয় হে’-র মূল কবিতার প্যারডি করেছিলেন নলিনীকান্ত সরকার। লিখেছিলেন,
ঘন ঘন ধনমপি নায়ক জয় হে জয়ন্তিভাগ্যবিধাতা!
ইংলণ্ড-ফ্রান্স-সুইডেন-ইটালী-আরব-তুর্কী-কঙ্গো-আল্পস-ককেশস-দনিয়ুব-ভলগা-নাইল-মিসিসিপি-হংহো
তব ফরমাসে আসে বাংলা কবিতা চাষে
পূরিল কৃষ্টির খাতা।
ঘন ঘন লাঙল-দায়ক জয় হে, জয়ন্তিভাগ্যবিধাতা!
আর নজরুলকে নিয়ে তো আক্রমণের ঝড় বইয়ে দিয়েছিল এ পত্রিকা। মাসিক ‘শনিবারের চিঠি’র প্রথম সংখ্যায় মধুকর কাঞ্জিলাল-এর নামে ‘তোমাদের প্রতি’ বলে একটি কবিতা ছাপা হয়। যা আদতে নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাকে ব্যঙ্গ করে লেখা-
ওগো বীর
ফেলে দিয়ে কাঁথা আর খাটিয়া তাকিয়া
ওঠো, জাগ, গা ঝাড়িয়া, চুল রগড়িয়া
তবু উচ্চ শির…
বিদ্রোহীকে ব্যঙ্গ করেছিলেন খোদ পত্রিকা সম্পাদক সজনীকান্ত দাস-ও। তাঁকে ‘প্রেম রসায়নে’ পাকা ‘প্রেমিস্ট’ আখ্যা দিয়ে চরিত্র হনন করতেও ছাড়েনি ‘শনিবারের চিঠি’। নজরুলকে ‘বাংলার আধুনিক বরপুত্র নবযুগ ধুরন্ধর সাহিত্য সারথি’ আখ্যা দিয়ে তাঁর ‘অনামিকা’ কবিতার একটি প্যারোডি ছাপা হয় ‘বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ’ নামে, রচয়িতা গাজী আব্বাস বিটকেল। তিতিবিরক্ত নজরুল ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় পরে লেখেন, ‘প্রতি শনিবারে চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, তুমি হাঁড়িচাচা।’ বিরক্ত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথও। শোনা যায়, একান্ত সচিব কবি অমিয় চক্রবর্তীর লাঞ্ছনার কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ নিজেই নাকি তাঁকে সজনীকান্তের বিরুদ্ধে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
-: আরও শুনুন :-
শিল্পীকে ক্ষতবিক্ষত করাই এ দেশের অভ্যাস! তারাশঙ্করকে কেন বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ লেখকদের সংখ্যায় সংখ্যায় তুলোধোনা করে শনিবারের চিঠি সেসময় চর্চার কেন্দ্রে উঠে এসেছিল। আর আক্রমণের নিশানায় ছিল ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর কবিদের লেখা আধুনিক কবিতা। ১৯৩২ সাল নাগাদ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের বিখ্যাত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশ পায় জীবনানন্দের ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটি। অথচ সে কবিতাকে নির্মম কাটাছেঁড়া করে সজনীকান্ত লিখলেন,
বনের যাবতীয় ভাই-হরিণকে তাহাদের হৃদয়ের বোন ঘাই-হরিণী আঘ্রাণ ও আস্বাদের দ্বারা তাহার পিপাসার সান্ত্বনার জন্য ডাকিতেছে। পিস্তুতো মাস্তুতো ভাই-বোনদের আমরা চিনি। হৃৎতুতো বোনের সাক্ষাৎ এই প্রথম পাইলাম।…
জীবনানন্দের ‘বোধ’, ‘মাঠের গল্প’, ‘ঘোড়া’-র মতো একাধিক বিখ্যাত কবিতা নিয়ে যুক্তিতর্ক ছাড়া আক্রমণ শানিয়েছে ‘শনিবারের চিঠি’, তেমনই জীবনানন্দকে বিঁধতে ‘জীবানন্দ’ বা ‘জিহ্বানন্দ’; ‘কবি-গণ্ডার’- কী না বলেছেন সজনীকান্ত!
সত্যি বলতে, কোন শিল্প কার ভালো লাগবে আর কার লাগবে না, তার কোনও নির্দিষ্ট ব্যাকরণ নেই। ভালো লাগলে যেমন তা নিয়ে কেউ দু’কথা বলেন, তেমনই খারাপ লাগলেও তা বলতে পারেন বইকি। যে কোনও সৃষ্টির প্রতি সমালোচনামুখর হওয়া দোষের কিছু নয়। বরং তা স্বাস্থ্যকর। তবে আক্রমণকে তো সমালোচনা বলা চলে না। সমকালে যে প্রবণতা প্রায়শই মাথাচাড়া দেয়, ‘শনিবারের চিঠি’কে তারই পথপ্রদর্শক বলা চলে অনায়াসেই। সেই প্রবণতার কারণে এ পত্রিকা নিন্দাও কুড়িয়েছে। কিন্তু শতবর্ষে এসে এ কথাও মাথায় রাখতে হয় যে, ‘শনিবারের চিঠি’-র লেখকগোষ্ঠী কিন্তু শিল্পসাহিত্যের চর্চা না করেই তাকে খারাপ বলে দাগিয়ে দেওয়ার বদভ্যাসটি রপ্ত করেননি। তাঁরা আক্রমণ করতেন, অনেকসময় তা সীমাও ছাড়াত, কিন্তু হিউমার বা স্যাটায়ারেও তাঁদের অনেকেরই প্রশ্নাতীত দক্ষতা ছিল। তাই রবীন্দ্রনাথই বলেছেন, “শনিবারের চিঠিতে ব্যঙ্গ করবার ক্ষমতার একটা অসামান্যতা অনুভব করেছি। বোঝা যায় যে এই ক্ষমতাটা আর্ট-এর পদবীতে গিয়ে পৌঁছেচে।” সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ মনে করিয়ে দেন, এই ক্ষমতার স্থান আসলে সাহিত্যের অস্ত্রশালায়, ব্যক্তিবিশেষের মুখ বন্ধ করা তার কাজ নয়। অর্থাৎ কেবল ভালো না-লাগা নিয়ে কটু আক্রমণ শানানো যে আসলে ফলহীন, শিল্পীর প্রতি নিছক ব্যক্তি আক্রমণ যে শিল্প কিংবা ব্যক্তি কারও ভাঁড়ারেই নতুন কোনও ফসল তোলে না, সে কথাই বুঝিয়েছিলেন তিনি। আর শতবর্ষ পরেও ‘শনিবারের চিঠি’ যে কেবল শিল্পীদের প্রতি আক্রমণ ছাড়া অন্য কোনও সাহিত্যিক স্মৃতি ফেরাতে পারে না, তা থেকে বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথ সেদিন ভুল বলেননি আদৌ।