শিবলিঙ্গ সর্বতীর্থময়। তীর্থদর্শন, দান-ধ্যান, পূজার্চনা করে যা ফল লাভ হয়, তার কয়েকগুণ পুণ্যলাভ সম্ভব শিবলিঙ্গের দর্শনে। ভক্তিভরে কেউ একবার শিবলিঙ্গ প্রণাম করলেই সব দুঃখ নাশ হয়। তবে এর প্রকারভেদ রয়েছে। কোন শিবলিঙ্গের কী মাহাত্ম? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
শিবকে সাধারণত ‘শিবলিঙ্গ’ নামক বিমূর্ত প্রতীকে পূজা করা হয়। শাস্ত্রে বলে, যে কোনও শিবলিঙ্গ সে মানুষের দ্বারা স্থাপিত হোক অথবা অথবা স্বয়ম্ভূ, সঠিক উপাচারে পূজা করলে মানুষের মুক্তিলাভ হয়। শিবলিঙ্গের দর্শন এবং ভক্তিভরে নমস্কার জানালেই মানুষের অসীম কল্যাণ হয়। স্রেফ মহাদেব নন, বিশেষ এক শিবলিঙ্গে সমস্ত দেবতার পুজার্চনা সম্ভব। যা বাণাসুরকে দান করেছিলেন স্বয়ং মহাদেব।
:আরও শুনুন:
বিষ্ণুর রূপের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়েছিলেন স্বয়ং মহাদেব, কী মাহাত্ম্য মোহিনী একাদশীর?
এমনিতে শিবপুজোর কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। যেকোনও অবস্থায় ভক্তিভরে স্মরণ করলেই কৃপা করেন মহেশ্বর। তবে শ্রাবণের গুরুত্ব কিছুটা হলেও আলাদা। কথিত আছে, এ হল শিবের জন্মমাস। তাই বছরের এই কটা দিন কেউ ভক্তিভরে পুজো করলে নিশ্চয়ই ফল পাবেন, এমনটাই বলে থাকেন শাস্ত্রজ্ঞরা। আর শিবপুজো মানেই শিবলিঙ্গের পুজো। শিব শব্দের একটি অর্থ হল যাঁর মধ্যে প্রলয়ের পর বিশ্ব নিদ্রিত থাকে। লিঙ্গ শব্দটির অর্থও একই, বিশ্বধ্বংসের পর যেখানে সকল সৃষ্ট বস্তু বিলীন হয়ে যায়। শাস্ত্রে শিবকে দেবাদিদেব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ সৃষ্টির আদিতে কেবলমাত্র তাঁরই অস্তিত্ব ছিল। তিনিই লীলাচ্ছলে ব্রহ্মারূপে সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণুরূপে পালনকর্তা, আবার রুদ্ররূপে সংহারক। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, এই তিন রূপের মধ্যে সত্বার কোন পার্থক্য নেই। এরই পরিচয় মেলে শিবলিঙ্গের এই বিশেষ ধরণে। শাস্ত্রে এর উল্লেখ বাণলিঙ্গ হিসেবে। সাধারণ শিবলিঙ্গের মতো সাদা বা কালো নয়। এর রং খানিকটা বাদামী বর্ণের। যদিও তা প্রকৃতির সৃষ্টি। আলাদা করে বাদামী রং করা পাথরকে বাণলিঙ্গ বলা যায় না। মধ্যপ্রদেশের নর্মদা নদীর ধারে এই বিশেষ পাথর পাওয়া যায়। শাক্ত ও স্মার্ত সম্প্রদায়ের মানুষ এই লিঙ্গেই শিব সহ বিভিন্ন দেবদেবীর আরাধনা করেন। পুরাণে এই নিয়েই এক কিংবদন্তি রয়েছে।
:আরও শুনুন:
দশমহাবিদ্যার অন্যতমা দেবী ষোড়শী, সেই রূপেই মা সারদার পূজা করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ
পুরাকালে বাণ নামের এক শিবভক্ত অসুর ছিল। সে রোজই ভক্তিভরে শিবের পূজা অর্চনা করত। একদিন বাণাসুরের ভক্ততে তুষ্ট হয়ে মহাদেব দেখা দিলেন। ভক্তকে আশীর্বাদ করে বর চাওয়ার কথা বললেন মহেশ্বর। আনন্দে আত্মহারা বাণাসুর এইসময় আরাধ্য দেবাদিদেবকে বলেন, ‘প্রভু প্রতিদিন আপনার পূজার জন্য লিঙ্গ তৈরি করতে আমার খুব কষ্ট হয়। আপনি আমার ওপর কৃপা করে, আমাকে সুলক্ষণযুক্ত শিবলিঙ্গ দান করুন যাতে আমি মনের আনন্দে আপনার যথাবিহিত পূজা করতে পারি’। বাণাসুরের কথায় প্রসন্ন হয়ে দেবাদিদেব তাঁকে সুলক্ষণযুক্ত চোদ্দ কোটি শিবলিঙ্গ প্রদান করলেন। বাণাসুর সেইসব লিঙ্গ নিয়ে জগতের মঙ্গলকামনায় নানা জায়গায় স্থাপন করেন। জানা যায়, শ্রীশৈলে তিন কোটি, কন্যাশ্রম, কন্যাতীর্থ, মহেশ্বরক্ষেত্র, মহেন্দ্র পর্বত, নিউয়ারে এক কোটি এবং অবশিষ্ট অক্ষয় লিঙ্গগুলি অন্যান্য স্থানে স্থাপন করেন। এর মধ্যে বহু জায়গায় মন্দির তৈরি হয়েছে। সেখানে নিয়মিত ভিড় জমান ভক্তরা। এছড়া স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গও রয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। যার মধ্যে অমরনাথ গুহায় বরফবৃত লিঙ্গটি বেশ জনপ্রিয়। এছাড়া দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ আলাদা মাহাত্ম বহন করে। প্রচলিত শিবলিঙ্গটি অবশ্য যে কেউ তৈরি করতে পারে। মাটি, পাথর, পারদ কিংবা স্ফটিক দিয়ে শিবলিঙ্গ তৈরি করা যায়। আবার কিছু মন্দিরে শিবের তিনমুখী লিঙ্গ পুজোর চলও রয়েছে। তবে লিঙ্গের ধরণ বা আকার যাই হোক, ভক্তিতেই তুষ্ট হন মহাদেব। উপাচার হিসেবেও বেলপাতা আর গঙ্গাজলই যথেষ্ট। তাতেই যে কোনও বিপদ থেকে মুক্ত করেন মহেশ্বর।