কলকাতার ট্রাম। দেড়শো বছর বয়স হল তার। এবার হয়তো ছুটির ঘণ্টা বাজবে বরাবরের মতোই। প্রয়োজনের জীবনে হয়তো সে বাড়তিই, তবুও নস্টালজিয়ায় ডুব দিয়ে কি তার জন্য একটুও মনখারাপ হবে না বাঙালির?
বিয়ে করে ঘরসংসার পেতেছিল অল্পবয়সি দুই তরুণ তরুণী। নেহাতই সাদাসিধে তারা, গতে বাঁধা তাদের রোজকার জীবনও। সে জীবনে কোনও দিন ট্রামের তার খারাপ হয়ে গিয়ে ছেলেটির ঘরে ফিরতে দেরি হয়। পথ চেয়ে থাকা বধূ দেরি দেখে অস্থির হয়ে ওঠে। কোনও দিন আবার সেই চলতি জীবনেই একচিলতে অন্য রং লাগিয়ে দেয় একটি গোড়ের মালা। বউয়ের খোঁপার জন্য মালা কিনতেই ট্রামের পয়সা বাঁচিয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরে বর। এমন করেই, কলকাতার আমজনতার ভিড় থেকে তুলে আনা এই যুগলের গল্পে নেপথ্য চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল শহরের ট্রাম।
গল্পের নাম ‘শুধু কেরাণী’। লিখছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। সেকালের কলকাতার গতে বাঁধা জীবনই যখন ট্রামের লাইনে বাঁধা, তখন গতানুগতিক মানুষের জীবনে তো সে এমন করেই জড়িয়ে যাবে। সত্যি বলতে এ শহরটার গড়ে ওঠা, ছড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে গত দেড়শো বছর ধরে জড়িয়ে আছে ট্রামকাহিনি। ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় প্রথমবার ট্রামের চলা শুরু। বিদ্যুতের তার টেনে নয়, ঘোড়ার খুরে তাল মিলিয়ে। শিয়ালদা থেকে শুরু করে বৌবাজার, ডালহৌসি স্কোয়ার হয়ে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত তার সীমা। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেই ট্রাম অবশ্য বেশিদিন চলেনি। ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ নভেম্বর, এইটুকুই ছিল কলকাতার প্রথম ট্রামের পরমায়ু। ১৮৮০-র ১ নভেম্বর লর্ড রিপনের হাতে নতুন করে পরিষেবার উদ্বোধন হল বটে, কিন্তু তখনও গণপরিবহণের ট্রাম যেন যাত্রীদের নিজস্ব যান। তাঁরা যেখান থেকে ইচ্ছে ওঠেন, যেখানে ইচ্ছে নেমেও পড়েন। ১৮৮০ সালেরই জাতক রাজশেখর বসু যেমন ‘চিকিৎসা সঙ্কট’ গল্পে লিখছেন, বন্ধুকে দেখেই হুড়মুড়িয়ে ট্রাম থেকে নামতে গিয়ে কী বিপাকে পড়লেন এক ধনী যুবক, আর সেই বিপাক কীভাবে গড়িয়ে গেল চিকিৎসক থেকে বউ খুঁজে পাওয়ার মধুরেণ সমাপয়েতে। তবে উচ্চবিত্ত নয়, মূলত মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত বাঙালিরই পরিবহণের বড় ভরসা হয়ে দাঁড়ায় ট্রাম। শিবরাম চক্রবর্তী যেমন ‘স্বামী হওয়ার সুখ’ গল্পে এক চরিত্রকে দিয়ে বলান, “আপিস বেরোবার মুখে কী করে ট্রামে চাপব শুধু এই এক সমস্যা ছাড়া আর কোনো চিন্তা আমাদের মনে স্থান পায় না।” আমজনতার সাধ্যে কুলোয় বলেই ট্রাম যে ভিড়ে ভিড়।
সেকালের কলকাতার কেরানি বাঙালি অফিসে যায় আসে ট্রামে চড়ে, আবার ছুটির দিনে বেড়াতে বেরোলেও তার সাধ্য ট্রামের সস্তা টিকিটেই আটকে থাকে। ট্রামের ভাড়া বাঁচিয়েই সে কখনও বউয়ের খোঁপার মালা কেনে, কখনও বা ওষুধ। তাই ট্রামের ভাড়া এক পয়সা বাড়লেও কলকাতাকে আন্দোলনে নামতে হয়। ১৯৫৩ সালে বিধান রায়ের সরকারের বিরুদ্ধে সে আন্দোলনে হাজির ছিলেন জ্যোতি বসুরা। ‘হে প্রবাসী’ উপন্যাসে সে বিক্ষোভের ছবি আঁকেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, “যখন তখন ট্রামে উঠে বলা ভাড়া দেব না!… কেউ আপত্তি করলে ঘুষি মারার জন্য হাতের মুষ্টি উদ্যত ছিল। কণ্ডাক্টরদের নিরুত্তাপ ব্যবহারের জন্যই বাধ্য হয়ে কলেজ ক্যাণ্টিনে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল ট্রাম পোড়াবার! ট্রাম পোড়ানো এত সোজা, বাসের মত ঝামেলা নেই!” আরও পরের বাঙালি অবশ্য গণ-প্রতিবাদের ধার ধারে না, সে স্রেফ কন্ডাকটরের সঙ্গে কম পয়সায় ভাড়া রফা করতে চায়- “ট্রামে উঠেই মাথা গরম হয়ে গেল অর্কর। চার জন লোক বসেছিল সামনে, কণ্ডাক্টর টিকিট চাইতেই তারা চোখ মটকে হাসল। কণ্ডাক্টর দ্বিতীয়বার চাইতেই একজন বলল, পরে দেব, বুঝতে পারছেন না?” সমরেশ মজুমদারের ‘কালপুরুষ’ উপন্যাসে এই দুর্নীতি দেখে গলা চড়ায় অর্ক। তবে ট্রামে ভাড়া না দেওয়ার গল্প কি নতুন নাকি? ১৮৮০ সালেই এক বিবরণ বলছে, কন্ডাকটর অতিরিক্ত যাত্রী তোলায় বিডন স্ট্রিট থেকে ট্রামে উঠে পুলিশ কোর্ট পর্যন্ত পুরো রাস্তা বাবু আহুরলাল সেনকে দাঁড়িয়ে যেতে হয়েছিল। নামার সময় তাই ভাড়া দিতেই আপত্তি জানালেন তিনি। সেই নিয়ে বাগবিতণ্ডার জল গড়াল আদালতে। কিন্তু প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে বিচারপতি রায় দিলেন, ভাড়া না দিয়ে যাত্রী কোনও অন্যায় করেননি। কেন-না, যাত্রীর সুবিধা অসুবিধার দিকে খেয়াল রাখা তো ট্রাম কর্তৃপক্ষেরই কর্তব্য।
অন্য সুবিধার কথা ছেড়েই দিই, দেড়শো বছর পেরিয়ে বর্তমানে যাত্রীদের দ্রুত যাতায়াতের সুবিধা দেওয়াই আর ট্রামের সাধ্যে কুলোয় না। অন্যান্য দ্রুতগামী যানবাহনের ভিড়ে সে দীর্ঘদিন ধরেই কোণঠাসা। কলকাতা ট্রামের প্রথমবারের অকালমৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে শ্রীপান্থ লিখেছিলেন, “কলকাতা শহর একা ট্রামের পায়ে চলে না। বাস আছে, ট্যাক্সি আছে, রিক্সা আছে— তার উপর আছে আমাদের এই সনাতন পদযুগল।” সে কথাই এখন আরও স্পষ্ট হয়ে ট্রামের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়েছে। মহানগরীর গতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা বুড়ো ট্রাম বরাবরের মতোই হয়তো ঘুমের দেশে পাড়ি দেবে এবার। বাঙালির দ্রুত জীবনেও এখন আর ট্রামের তেমন অস্তিত্ব নেই। তবু, ট্রামভাড়া বাঁচিয়ে স্ত্রীকে মালা কিনে দিত যে বাঙালি, ট্রাম বন্ধ হয়ে গেলে একটুও কি দুঃখ হবে না তার?