বিবাহবিচ্ছেদ হলে খোরপোশ চাইতে পারবেন মুসলিম মহিলারাও। এমনকি সে বিচ্ছেদ তিন তালাকে হলেও। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় মুসলিম মহিলাদের অধিকারের জমি কি আরেকটু শক্ত করল, নাকি উদ্বেগই বাড়াল আসলে? কিন্তু কেন সেই উদ্বেগ? শুনে নেওয়া যাক।
দেশের অন্য যে কোনও বিবাহিত মহিলার মতোই, কোনও মুসলিম মহিলাও বিবাহবিচ্ছেদের পরে খোরপোশের দাবিদার। এক ঐতিহাসিক রায়ে এ কথা সাফ জানিয়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। জানিয়ে দিয়েছে, খোরপোশ পাওয়া স্ত্রীর অধিকারের মধ্যেই পড়ে। খোরপোশকে যদি স্বামীরা তাঁদের স্ত্রীর প্রতি দাক্ষিণ্য বা খয়রাতি ভাবেন, তবে ভুল করবেন। আর দেশে যে খোরপোশ আইন চালু রয়েছে, তা সমস্ত ধর্মের মহিলাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু সেই রায়ে খুশি হবেন, নাকি অন্য পথে চিন্তাই বাড়বে তাঁদের, ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না অনেক মুসলিম মহিলাই।
আরও শুনুন:
তিন তালাকে খোরপোশ? সুপ্রিম কোর্ট নয়, কোরানের রায়কেই চূড়ান্ত মান্যতা মুসলিম নেত্রীর
বস্তুত, গৃহবধূদের টাকা দেওয়া নিয়ে যেন একধরনের অস্বস্তি জারি আছে গোটা সমাজেই। গৃহশ্রমকে শ্রম বলে যেমন ভেবেই উঠতে পারেন না অনেকে, তেমনই অনেকেই মনে করেন গৃহবধূদের কোনও টাকা দেওয়া মানে তা শ্রমের মূল্য নয়। সরকারি ভাতা নিয়েও যেমন এ কথা শোনা যায়, একইভাবে বিবাহবিচ্ছেদের পর স্ত্রীর খোরপোশের দাবি নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। তার উপরে শরিয়ত আইনের আলাদা প্রয়োগের কারণে মুসলিম মহিলাদের বিয়ে সংক্রান্ত আইন বেশ জটিল ছিল। আরও ধোঁয়াশা ছিল তাঁদের অধিকারের প্রশ্নে। তিন তালাক মুসলিম পুরুষদের এই সুবিধে দিয়েছিল যে, যে কোনও সময় তিনবার ‘তালাক’ শব্দটি উচ্চারণ করলেই ভেঙে যাবে বিয়ে। বিবাহবিচ্ছেদ সেক্ষেত্রে একইসঙ্গে সহজ এবং দায়িত্বহীন ছিল। যে মহিলারা কোনোভাবেই আর্থিক উপার্জন করেন না, উপরন্তু যাঁরা দুঃস্থ, সহায়সম্বলহীন; এই দায়দায়িত্বহীন বিচ্ছেদ তাঁদের মাথার ছাদ আর পেটের ভাত কেড়ে নিতে পারত একইসঙ্গে। সেখানে তিন তালাক নিষিদ্ধ করার পর, এই খোরপোশের আইনি নির্দেশ মুসলিম নারীদের অধিকারের জমিটি একটু শক্ত করল বলেই মনে হয়। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। সেই বিষয়টি নিয়েই ভয়ে কাঁটা মুসলিম মহিলাদের একটা বড় অংশ।
আরও শুনুন:
তিন তালাকের কফিনে খোরপোশ পেরেক, অধিকার আরও পোক্ত মুসলিম মহিলাদের?
প্রথম কথা হল, সরকার তিন তালাককে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও লুকিয়েচুরিয়ে যে তার সুবিধা নিচ্ছে কেউ কেউ, এই রায়েও সে কথা বোঝা যাচ্ছিল। খোরপোশ দেওয়ার ভয়ে তা নাহয় বন্ধ হল। কিন্তু তার দরুন স্ত্রীর প্রতি অত্যাচার যে বাড়বে না, তার তো নিশ্চয়তা নেই। তিন তালাক রদের পরেই শোনা গিয়েছিল, আইনের বিরোধিতা করতে না পেরে বিচ্ছেদের জন্য অন্য পথ খুঁজতে চাইছেন মুসলিম পুরুষদের একাংশ। মুসলিম সমাজে পুরুষদের বিচ্ছেদ নেওয়ার জন্য যেমন তিন তালাক প্রথা ছিল, তেমনই ‘খুলা’ প্রথার মাধ্যমে কোনও নারীও বিচ্ছেদের পথে হাঁটতে পারেন। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে স্ত্রীকে নির্যাতন করে ‘খুলা’ প্রথা অবলম্বন করার দিকে ঠেলে দিচ্ছে অনেকে। সেখানে স্ত্রী নিজেই বিচ্ছেদ চাইছেন বলে তাঁকে খোরপোশ দেওয়ারও প্রশ্ন ওঠে না। অর্থাৎ মুসলিম মহিলাদের পরিস্থিতি যে তিমিরে ছিল সেখানেই থেকে যাচ্ছে।
দ্বিতীয় কথা হল, তিন তালাক রদ হলেও, শরিয়ত মতে বহুবিবাহ তো চালু। ফলে বিচ্ছেদ না করেও ফের বিয়ে করতে বাধা নেই। অনেক মহিলারই ভয়, খোরপোশ দেওয়া এড়াতে বিচ্ছেদ হয়তো দেবেন না স্বামী, তবে ফেলে চলে যাবেন। সেখানে আইনি শাস্তিও এড়ানো যাবে, অথচ দায়িত্বও নিতে হবে না। সুপ্রিম কোর্টের রায় যতই ইতিবাচক হোক, বাস্তবে তা মুসলিম মহিলাদের জন্য হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়াবে কি না, আপাতত সেই আশঙ্কাতেই দিন গুনছেন মহিলারা।