বিশ্বকাপ হাতে ছোঁয়া হল না যাঁর, দেশের অন্তত দুটো বিশ্বকাপ জয়ে থেকে গেল তাঁরই ভাবনাবীজ। নতুন এই পৃথিবীতে ভারতীয় ক্রিকেটের বিশ্বায়নের নেপথ্যে থেকে গেলেন সেই অধিনায়ক, সাফল্যের বহুল মুহূর্ত থেকে যিনি দূরেই। বহুকাল আগে ক্রীড়াসাহিত্যিক রাখাল ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘ক্রিকেটের দীর্ঘ ও গৌরবময় ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ইনিংস ব্যাট থেকে উৎসারিত হয়নি, তা হয়েছে একজনের কলম থেকে, তিনি নেভিল কার্ডাস।’ এই কথা ধার করে আমরা বরং বলি, ভারতীয় ক্রিকেটের দীর্ঘ ও গৌরবময় ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অধিনায়কত্ব ট্রফির সংখ্যায় বিচার্য হয়ে হয়নি, বরং তা ধরা দিয়েছে একজনের দূরদর্শিতায় আর মানসিকতায়, তিনি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
লিখলেন সরোজ দরবার।
ক্রিকেট আসলে ব্যাকরণ-ভাঙা খেলা। শঙ্করীপ্রসাদ বসু বলেছিলেন ‘ভূগোল-ভাঙা’। যে খেলা সব মানচিত্র মুছে দিয়ে সর্বজনীন নায়কের জন্ম দেয়, আবার স্বতন্ত্র ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যকে হেলাফেলা করে না। এই ধারণাটুকু ধার করে নিয়ে আমরা বলতে পারি, ক্রিকেট আসলে সেই ব্যাকরণ, যা নিজেকেই ভেঙেচুরে নতুন ব্যাকরণ গড়ে নেয়। তথাকথিত কপি-বুক যা কিছু তা ফ্রেম করে বাঁধিয়ে রাখা যায়। তবে মনে যা বাঁধা পড়ে থাকে তা কপি-বুককে খানিক কটাক্ষ হেনেই যেন নতুন ব্যাকরণ সম্ভব করে তুলতে। তবে সকলেই নয়, কেউ কেউ পারেন ক্রিকেটের সাজানো বাগানে সেই বেপরোয়া হাওয়া খেলিয়ে দিতে। যেমন, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্য ভারতীয় ক্রিকেটমহল বহু বিশেষণ জোগাড় করেছে খেটেখুটে। তিনি ‘গড অফ অফসাইড’, ‘প্রিন্স অফ ক্যালকাটা’, আর বাঙালির কাছে তিনিই ‘মহারাজ’, তিনি-ই ‘দাদা’। তবে, সত্যি কথা বলতে গেলে তিনি বাঙালির নতুন ব্যাকরণ। ভারতীয় ক্রিকেটেও। যেখানে সময়ের দাবি মেনে লেখা হচ্ছে দেশের ক্রিকেটের নতুন ভাষাতত্ত্ব। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ভারতীয় ক্রিকেটে ভীষণ নতুন। রবীন্দ্রনাথ নতুনকে নিষ্ঠুর বলেছিলেন। খাঁটি কথা। ফলত নতুন সৌরভকে মেনে নিতে সময় লেগেছে সময়েরই, আর সেই কারণে সব রকম নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হয়ে নীলকণ্ঠ হতে দ্বিধা ছিল না তাঁর; কেননা নীল জার্সির পৃথিবীটাকে যিনি নিজের মতো করে গড়ে নেবেন, নিতে চাইবেন, তিনি যন্ত্রণায় নীল না হয়ে থাকেনই-বা কী করে! মজার বিষয় হল, উপহার দেওয়া যন্ত্রণায় যতবার তাঁকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে, ততবার তিনি এসে ঘা দিয়েছেন দ্বারে। তাঁকে দল থেকে, অধিনায়কের পদ থেকে এমনকী দেশের ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থার শীর্ষ থেকেও সরিয়ে দেওয়া যেতে পারে। তা হয়েওছে। কিন্তু সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় সেই ধারাবাহিক উপন্যাস, যার শীর্ষনাম ‘কামব্যাক’। বাঙালি জানে, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যেন মতি নন্দীর কোনও উপন্যাসেরই জীবন-সংস্করণ। অতএব ভারতের ক্রিকেট, বিশেষত বিশ্বায়নের হাওয়া লাগা দেশের ক্রিকেটের সর্বত্রগামী হয়ে ওঠা নিয়ে যতবার কথা ওঠে, তাঁকে সরিয়ে রাখা যায় না কিছুতেই।
রাখা যায়-ই বা কী করে! টালমাটালে দেশের হাল ধরার সময়ই তিনি জানতেন কাণ্ডারীকে হুঁশিয়ার না হলে চলে না। অতএব হাত দিলেন নতুন সংস্করণের কাজে। একটা ঝকঝকে তুখোড় এডিশন না হলে চলে না। তাই বলে সেই সংকলনে মহার্ঘ অধ্যায় কি বাদ দেওয়া যায়! বিশেষত যদি সেই সব অধ্যায়ের নাম হয় শচীন তেন্ডুলকর, রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণ কিংবা অনিল কুম্বলে! অতএব সৌরভ হয়ে উঠলেন সেই সম্পাদক যিনি সেহবাগ, ধোনি, যুবরাজ, হরভজন, জাহিরের মতো তরুণদের সঙ্গে প্রবীণদের মিলিয়েই দেশের জন্য একটি কালেক্টর এডিশনের পরিকল্পনা করতে পারেন। করলেনও। সেহবাগকে ছেড়ে দিলেন নিজের জায়গা। বিস্মিত বীরু বলেছিলেন, সফল না হলে দল থেকে বাদ পড়বেন না তো! দাদা কি তা সাদা পাতায় লিখে দেবেন! সৌরভ সম্ভবত মুচকি হেসেছিলেন। কেননা তরুণদের স্বপ্নকে তিনি নিজের অধিনায়কত্ব বাজি রেখেও যে লালন করবেন, এমন ছাড়পত্র তো জেদের বশে আগেই আদায় করে রেখেছিলেন। অতএব পরপর কয়েকটি ম্যাচে লোয়ার অর্ডারে ব্যর্থ হওয়া মহেন্দ্র সিং ধোনি উঠে এলেন উপরে। নড়বড়ে পেসের সংসারে নতুন অক্সিজেন জোগাতে শুরু করলেন জাহির খান নামে দমকা হাওয়া। আর তরুণ হরভজন যে ইডেনে ভেলকি দেখাবেন তার মুখবন্ধ তো তিনি আগেই লিখে রেখেছিলেন। এদিকে সেই দুর্দান্ত অস্ট্রেলিয়া সফরে অনিল কুম্বলে কিছুতেই দলে রাখতে রাজি নন নির্বাচকরা। ফর্ম খারাপ চলছে কুম্বলের। দলে জায়গা হওয়ার কথা হরভজন আর মুরলী কার্তিকের। সৌরভ নিজে খুব ভালোই চেনেন ফর্ম আর ক্লাসের ভিতর পড়ে থাকা আকাশটিকে। তিনিও তাই জেদ ধরে বসলেন, কুম্বলের নাম লেখা না হলে টেবিল ছাড়বেন না। তাতে যদি অধিনায়কত্বের চাকরি যায়! গেলে যাবে! কুম্বলে উড়ে গেলেন ভিনদেশে, ফিরলেন সেই সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হয়ে। এমনকী যে গ্রেগ চ্যাপেল তাঁর জীবনে ভবিষ্যতে ‘ঘরশত্রু’ হয়ে উঠবেন, তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর কাজটিও তিনিই করেছিলেন। এই হালফিল কুড়ি-বিশের বিশ্বকাপে যে সাফল্যে ভারত ভাসল, তার বীজতলাটিও তাঁর হাতেই নির্মিত। রোহিতকে অধিনায়ক করা আর রাহুলকে কোচ করা আসলে সেই তিন দশকের পরিচিত যেদ। যা বরাবর বলে এসেছে পরীক্ষা প্রার্থনীয়, ফলাফল হাতেনাতে।
এ সবই আসলে পুরনো কাসুন্দি। নাড়াচাড়ার করার অর্থ এই যে, সানি-কপিল পরবর্তী অধ্যায়ে ভারতের ক্রিকেট আধুনিক সময়ে যে আন্তর্জাতিকতার স্বাদ পেল, তার জন্য দরকার ছিল নতুন ব্যাকরণ। ঘটনাচক্র কিংবা নিয়তিনির্দিষ্ট এই যে, ভারতের জন্য সেই ব্যাকরণের নাম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়-ই। ক্রিকেটে ‘অস্ট্রেলীয়ত্ব’ বলে এক প্রাচীন প্রবাদ আছে। শেষ অব্দি না-হারার মানসিকতা এই একটা শব্দেই বুঝে যায় ক্রিকেটমহলে। ভারতীয় ক্রিকেট আজ যখন কয়েক যোজন এগিয়ে গিয়েছে, তখন পিছু ফিরে আমরা বলতে পারি, দেশের মাটিতে সেই মন আর মানসিকতার নামি ‘সৌরভত্ব’। যা হেরে গেলেও ব্যর্থ হয়ে যায় না। বরং আগামীর জন্য পথ খুলে যায়।
আর বাঙালির কে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়? আজও তার হিসাব মেলাতে পারে না বাঙালি। ক্রিকেটারের জার্সি থেকে বহুদিন আগেই তাঁর উড়ান বাঙালির যাপনের ইতিহাসে। তাঁকে নিয়ে কবিতা লেখা হয়, বই লেখা হয়। টিভি-শো বছরের পর বছরের চলতে থাকে তাঁরই মুখের ভরসায়। তাঁর কাজকর্ম, কথাবার্তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেদম সমালোচনাও হয়। সে সব সত্ত্বেও বাঙালি জানে, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বাঙালির মধ্যেও অন্যরকম বাঙালি। বাঙালির যে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার চির আক্ষেপ সে সবের উলটো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বিদঘুটে হিসাবহীন মানুষ। যিনি বঞ্চনা শব্দটিকেই পাত্তা দেন না। বরং বঞ্চনার লক্ষ্মণরেখা থেকে স্টেপ আউট করে এসে তাকে বাপি বাড়ি যা বলতেই তিনি অভ্যস্ত। নিজের কাজে ওই চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস, ওই কলার-তোলা রোয়াব, ওই জার্সি খোলা বোহেমিয়ানা কি বাঙালির গড়পড়তা বৈশিষ্ট্য? মোটেও নয়। আর নয় বলেই, তিনি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, বিশ্বায়ন-উত্তর বাঙালির সেরা আইকন। তিনি এসে দাঁড়ালে লাইন সেখান থেকেই শুরু হয়, আলো ঘুরে যায় আলোকময় আধারে।
অথচ সাফল্যের খতিয়ান ধরলে ধোনি তাঁকে অক্লেশে হারিয়ে দেবেন। বিশ্বকাপ হাতে ছোঁয়া হল না যাঁর, দেশের অন্তত দুটো বিশ্বকাপ জয়ে থেকে গেল তাঁরই ভাবনাবীজ। নতুন এই পৃথিবীতে ভারতীয় ক্রিকেটের বিশ্বায়নের নেপথ্যে থেকে গেলেন সেই অধিনায়ক, সাফল্যের বহুল মুহূর্ত থেকে যিনি দূরেই। বহুকাল আগে ক্রীড়াসাহিত্যিক রাখাল ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘ক্রিকেটের দীর্ঘ ও গৌরবময় ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ ইনিংস ব্যাট থেকে উৎসারিত হয়নি, তা হয়েছে একজনের কলম থেকে, তিনি নেভিল কার্ডাস।’ এই কথা ধার করে আমরা বরং বলি, ভারতীয় ক্রিকেটের দীর্ঘ ও গৌরবময় ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অধিনায়কত্ব ট্রফির সংখ্যায় বিচার্য হয়ে হয়নি, বরং তা ধরা দিয়েছে একজনের দূরদর্শিতায় আর মানসিকতায়, তিনি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।