আসলে সমাজ তো তাকেই ভালো মেয়ে বলে, যে সব কথা শোনে, সব নিয়ম মানে। যে মেয়েরা সমাজের বাইরের বাসিন্দা, সমাজের চলতি নিয়মকানুনকে তাদের খানিক অগ্রাহ্য করারই কথা। যৌনকর্মী এই মেয়েদের স্বভাবেও সেই প্রবণতাই থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু সমাজ ভালো মেয়ে বলতে যা বোঝে, বারেবারে ঠিক তেমন করেই যৌনকর্মীদের সাজিয়েছে বলিউড সিনেমা।
পেশায় যৌনকর্মী। খোলামেলা পোশাক, চোখ মুখের ভাবে গড়িয়ে পড়ছে লাস্য, শরীরী বিভঙ্গে স্পষ্ট যৌন আবেদন। কিন্তু গল্প যত এগোয়, দেখা যায় এ সবই কেবল মুখোশ। আদতে তার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে নিপাট ঘরোয়া আঁচল টানা একটি মেয়ে। তার হয়তো ঘরে থাকা হয়নি, কিন্তু যে মানুষরা ঘরে থাকে তাদের জন্য তার প্রাণ কেঁদে ওঠে। তেমন কোনও মানুষের বিপদে সে নিজেকে বিপন্ন করে পাশে দাঁড়ায়। আবার নিজের মতোই কোনও মেয়ের জন্যেও সে একইভাবে সহমর্মী। এমন চরিত্রদের বারবার তুলে ধরেছে বলিউড। যে মেয়েরা পেশায় যৌনকর্মী, অর্থাৎ সমাজের চোখে খারাপ মেয়ে। কিন্তু সমাজ ভালো মেয়ে বলতে যা বোঝে, ঠিক তেমন করেই এই যৌনকর্মীদের সাজিয়েছে বলিউড সিনেমা।
এক ঢিলে দুই পাখি মারার এই প্রবণতা কিন্তু আজকের নয়। এমন মেয়েরাও যে প্রাণ ঢেলে ভালোবাসতে পারে, ‘পাকিজা’-র মতো ছবি তা-ই দেখিয়েছিল। অথচ সমাজের বিধিনিয়মের কড়া গণ্ডি পেরিয়ে সে ভালোবাসা তো পূর্ণতা পায় না। সমাজে একঘরে হয়ে থাকা, প্রেমে একলা হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা, সবই সহ্য করতে হয় তাদের। ‘চাঁদনি বার’ বা ‘লক্ষ্মী’তে ফুটে উঠেছিল এমন মেয়েদের যন্ত্রণার কথাই। সাম্প্রতিক সময়েও বেগম জান, গাঙ্গুবাই কাথিয়াওয়াড়ি, হিরামান্ডির মতো ছবি বা সিরিজের উপজীব্য হয়েছে যৌনকর্মীদের জীবনযন্ত্রণা। কিন্তু কেবলমাত্র যৌনকর্মীদের গল্প বলার মধ্যে তো নতুন কিছু নেই। বলিউড আসলে যা করেছে, সমাজ এই মেয়েদের যে চোখে দ্যাখে, সেই দেখাটাকেই খানিক পালটে দিয়েছে। ‘খারাপ মেয়ে’ হয়েও যারা ‘ভালো মেয়ে’, এই ছকের মধ্যে দেখা যাবে ‘চামেলি’-র করিনা কাপুরকে। যে উদ্ধত রাগি রাহুল বোসকে বদলে দেয় তার ভালোবাসা দিয়ে। ‘চোরি চোরি চুপকে চুপকে’ ছবিতে সলমন আর রানির দাম্পত্যে যখন সন্তান আসে না, তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় প্রীতির অভিনীত যৌনকর্মী চরিত্রটি। যে প্রথমে টাকার বিনিময়েই সারোগেট মাদার হওয়ার কথা ভেবেছিল, কিন্তু ক্রমে সে সলমনকেও ভালোবেসে ফেলে, ভালোবেসে ফেলে তার শিশুকেও। আবার ‘লাগা চুনরি মে দাগ’ ছবিতে পরিবারের পেট চালাতেই যৌন পেশায় আসতে বাধ্য হয় বিভাবরী, যে চরিত্রটিতে অভিনয় করেন রানি মুখার্জি। এই ধারায় ‘দেবদাস’-এর চন্দ্রমুখীকেও মনে করতে হয় বইকি।
দেখা যাচ্ছে, সমাজ এদের খারাপ বলে দাগিয়ে দেয়, এদের একঘরে করে রাখে। অথচ ভালোবাসা, মায়া, মমতা, আত্মত্যাগ- এমন যে গুণগুলিকে সে ভালো মেয়েদের বৈশিষ্ট্য বলে দেখে, সেইসব গুণ এদের ঘিরে রেখেছে। অর্থাৎ সমাজের হিসেবেই এঁরা ভালো মেয়ে-র ছকেও খাপ খেয়ে যায়। এমনকি সিনেমার নায়িকা যেমন বিপন্ন হয় আর নায়ক তাকে উদ্ধার করে, সেই বিপন্নতার ছকেও এই মেয়েদের পুরে ফেলে বলিউড। আর এখানেই প্রশ্ন ওঠে, তাহলে কি এদের ঘিরে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিকে সিনেমা বদলাতে চায়, নাকি আরেকরকম প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিতেই এদের দ্যাখে? সেই দৃষ্টিভঙ্গিকে বলা চলে মেল গেজ, অর্থাৎ নারীর শরীরকে পুরুষ যেভাবে দ্যাখে তার বয়ান।
টিআরপি-কে গুরুত্ব দেওয়া বলিউড জানে, সিনেমা চলার জন্য নারীশরীরকে পণ্য করা তার কাছে জরুরি। কিন্তু নায়িকাকে কতখানি খোলামেলা দেখানো যাবে তার একটা গণ্ডি টানা আছে সবসময়েই, কেন-না ভালো মেয়েদের তো ‘নামিয়ে চক্ষু, মাথায় ঘোমটা টেনে’ চলতে হয়। যে শরীর দেখাবে সে ভালো মেয়ে নয়, এই শর্ত মেনে খলনায়িকাকে আনা হয়েছিল তাই। অথবা নায়িকাকে দুষ্কৃতীদের হাতে বিপন্ন অবস্থায় ফেলে দিয়ে মেল গেজ-কে তুষ্ট করা যেত। এখানে যৌনকর্মী জাতীয় কোনও চরিত্র দেখালে সেই দৃশ্যসুখ যে বেশি মাত্রায় মিলবে, তা বুঝতে সিনেমার ভুল হয়নি। কিন্তু তাকে চেনা ছকেই সাজানোর বদলে যদি ভালো করে তোলা হয়, তবে বিপন্ন নারীকে উদ্ধার করে পুরুষের যে রোমান্টিক সুখ মেলে, সেই শর্ত পূরণ করা যায়। একইসঙ্গে, খারাপ মেয়ের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার মধ্যে যে সমাজবহির্ভূত কাজের অস্বস্তি আছে, তা থেকেও মুক্তি মেলে।
আসলে সমাজ তো তাকেই ভালো মেয়ে বলে, যে সব কথা শোনে, সব নিয়ম মানে। যারা প্রশ্ন করে, যারা বিদ্রোহী, তারা সমাজের অভ্যস্ত ছকের বাইরে বলেই তাদের ভালো চোখে দেখে না এ সমাজ। যে মেয়েরা সমাজের বাইরের বাসিন্দা, সমাজের চলতি নিয়মকানুনকে তাদের খানিক অগ্রাহ্য করারই কথা। যৌনকর্মী এই মেয়েদের স্বভাবেও সেই প্রবণতাই থাকা স্বাভাবিক। যেমনটা দেখা গিয়েছে ‘দেভ ডি’-তে কাল্কি কোয়েচলিনের চরিত্রে, কিংবা বেগম জানের বিদ্যা বালান, হিরামান্ডির মনীষা কৈরালার চরিত্রে। কিন্তু সেই স্বভাব সরিয়ে রেখে তাদের সমাজের হিসেবে ভালো মেয়ে করে দেখালে ওই বিদ্রোহের অস্বস্তিও কাটিয়ে ফেলা যায়। যৌনকর্মী চরিত্রগুলিকে এইভাবে সাজিয়েই তাই একসঙ্গে দুই উদ্দেশ্য সাধন করেছে বলিউডি সিনেমা।