রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ইদ। কিন্তু সে ইদ আদৌ খুশির নয় এই অঞ্চলের মুসলিম বাসিন্দাদের কাছে। এখনও এ উৎসব তাঁদের কাছে বয়ে আনে এক অন্ধকার স্মৃতি।
ইদ মানে নতুন পোশাকের গন্ধ। সুখাদ্যের গন্ধে ম-ম করে ওঠা পাড়া। কোলাকুলি আর হাত ধরার দিন। কিন্তু এই মহল্লায় ইদ এলেও চুঁইয়ে পড়ে না তেমন কোনও রং-গন্ধ-হাসির কোলাজ। বদলে এক অন্ধকারের স্মৃতি ঘন হয়ে আসে ফের। যে অন্ধকারের গর্ভে জমা হয়ে আছে অনেক বুলেটের দাগ, রক্ত, কান্না আর হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা। ধর্মে মুসলিম হলেও, এই এলাকার মানুষের কাছে ইদ খুশির নয়, ক্ষতের এক দিন।
আরও শুনুন:
যে শহরে শিশু নেই, সেখানে বড়দিন আসে না
যোগীরাজ্যের মোরাদাবাদ জেলায় বাস তাঁদের। কিন্তু কেন ইদ তাঁদের কাছে এক কালো দিনের শামিল? আসলে, এক ইদের দিনেই যে তাঁদের জীবন বদলে গিয়েছিল। আর বরাবরের মতো বদলে গিয়েছিল ইদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কও।
সেটা ১৯৮০ সাল। আগস্ট মাসের ১৩ তারিখ। শান্তির ইদে সেদিন রক্তবন্যা বইতে দেখেছিল মোরাদাবাদ। সরকারি হিসেবেই মারা গিয়েছিলেন অন্তত শ-খানেক মানুষ, বাচ্চা বুড়ো কেউ বাদ ছিল না। আহতের সংখ্যার হিসেব নেই। আর হারিয়ে যাওয়া মানুষদের হিসেব কে-ই বা কবে রেখেছে! অথচ ঠিক কী যে হয়েছিল সেদিন, তারও হিসেব মেলানো ভার। প্রত্যেক বছরের মতোই ‘এক রাতওয়ালি মসজিদ’-এর সামনে ভিড় জমিয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। প্রার্থনা চলছিল, আর মসজিদের বাইরে বসেছিল দোকানপাটের পসরা। এর মধ্যেই গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল, এলাকায় একটি শুয়োর ঢুকে পড়েছে। ইসলাম ধর্মে এই পশুটি হারাম, ফলে ইদের দিনে এমন ঘটনা ঘটেছে শুনেই চটে যান মুসলিমদের একাংশ। সেই ক্ষোভ থেকেই পুলিশ ফাঁড়ির দিকে ইট পাথর ছোড়া শুরু হয়। যা দ্রুত হাতাহাতির চেহারা নেয়। লাগাতার গুলি আর কাঁদুনে গ্যাস ছুড়তে থাকে পুলিশ। এর মাঝে পড়ে দিশেহারা হয়ে যান সাধারণ মানুষেরা। কেউ গুলি খান, কেউ পালাতে গিয়ে পায়ের চাপে পিষে যান। অন্তত ৩৪ জন মানুষ পদপিষ্ট হয়েই মারা যান। আবার পুলিশের অভিযোগ, বিক্ষুব্ধ জনতার মারে সেদিন মৃত্যু হয়েছিল চার কনস্টেবল এবং খোদ অতিরিক্ত জেলাশাসক ডি পি সিং-এর। অন্যদিকে সেদিনই একের পর এক মুসলিম বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। তুলে নিয়ে যায় একাধিক জনকে।
আরও শুনুন:
পাঠ্য বইয়ে হাজির অযোধ্যা, বাদ বাবরি… ক্ষুব্ধ রামমন্দিরের প্রধান পুরোহিতই
সেই দিনের বুলেটের ক্ষত এখনও ধরে রেখেছে ইদ্গার দেওয়াল, আর সেদিনের স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই সময়কার কিশোর-তরুণেরা। এখন যাদের বয়স ৭০ কি ৮০-র কোঠায় এসে পৌঁছেছে, তবু সেই ক্ষতে এতটুকু প্রলেপ পড়েনি। যেমন হাজি ওয়াসিম ভুলতে পারেন না, একটি ঘরে চার সন্তানকে নিয়ে লুকিয়ে বসে ছিলেন তাঁর মা জামিলা খাতুন। পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান তিনিও। তিন দিন ধরে উঠোনেই পড়ে ছিল তাঁর দেহ, সৎকার করার অনুমতি মেলেনি। তারপর ময়নাতদন্তের নামে সে দেহ তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। আর কোনও দিনই মায়ের দেহাবশেষটুকুও পাননি ওয়াসিম। ইদ্গার দীর্ঘদিনের বাসিন্দা আরেক ব্যক্তি বলেন, গুলি খেয়েছিলেন তাঁর বাবা। আরেকজন বলেন, ভিড়ের চাপে তাঁর হাত থেকে ছেড়ে গিয়েছিল বোনের হাত। মানুষের পায়ের চাপে পিষে যায় ছোট্ট মেয়েটি।
কেবল মৃত্যুই নয়, হারিয়ে যাওয়ার গল্পও কম নেই। নাজিম হুসেনের বাড়িতে যেমন, তাঁর বাবা দরজা বন্ধ করে রেখেছিলেন। ভেতরে সিঁটিয়ে বসে ছিল গোটা পরিবার। পুলিশ এসে হানা দেয়। তুলে নিয়ে যায় তাঁর বাবা হাজি আনোয়ার হুসেন, ভাই সাজ্জাদ ও কাইজার, এবং গৃহসহায়ক আব্দুলকে। এতগুলো বছরে একের পর এক মর্গে ঘুরেছেন নাজিম, দেশের অন্তত ৭টি জেলে উঁকি দিয়েছেন, এমনকি আন্দামান নিকোবরের জেলে পর্যন্ত খুঁজতে গিয়েছেন তাঁদের। কিন্তু সেদিন পুলিশ যাদের টানতে টানতে নিয়ে গিয়েছিল, তাঁদের কোনও চিহ্ন আর কোথাও মেলেনি। যেমন করে হারিয়ে গিয়েছেন ইদ্গার আরও কোনও কোনও বাসিন্দার দাদা-বাবারা।
এ ঘটনাকে জালিয়ানওয়ালাবাগের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন তৎকালীন সাংসদ সৈয়দ সাহাবুদ্দিন। বিজেপি নেতা এবং প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম জে আকবর মোরাদাবাদ কাণ্ড নিয়ে লেখা বইয়ে সাফ বলেন, সেদিনের হিংসা আদৌ কোনও হিন্দু-মুসলিমের সাম্প্রদায়িক অশান্তি ছিল না। বরং হিসেব করে, ঠান্ডা মাথায় মুসলিম গণহত্যা করেছিল উগ্র সাম্প্রদায়িক পুলিশ বাহিনী, এমনটাই বলেছিলেন তিনি। কিন্তু সে কথায় কান দিয়েছে কে! ২০২৩-এ যোগী আদিত্যনাথ এ ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিলে একটু স্বস্তি মিলেছিল এই মানুষগুলোর। যদিও, অচিরেই তা মিলিয়ে গিয়েছে। উলটে তাঁদের পুরনো ক্ষতকে আরও খুঁচিয়ে দিয়ে গিয়েছে বিচারপতি সাক্সেনার রিপোর্ট। যেখানে পুলিশের দমননীতির কথা স্রেফ উড়িয়ে দিয়ে ক্লিনচিট দেওয়া হয়েছে তাদের। অশান্তির অভিযোগে আঙুল উঠেছে যথারীতি সেই মুসলিমদের দিকেই। যদিও কোলের শিশু কিংবা বৃদ্ধদের নিয়ে কি কেউ হিংসা ছড়াতে যায়? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি রিপোর্ট। পুলিশের দমননীতি যদি না-ই থাকে, তাহলে কী ঘটেছিল তাঁদের বাবা, মা, দাদা, বোনেদের সঙ্গে? ওয়াসিম-নাজিমদের সে প্রশ্নেরা এখনও ধাক্কা খেয়ে বেড়াচ্ছে ইদ্গার দেওয়ালে। সেদিনের পথ খুঁজে না পাওয়া অসহায় মানুষগুলোর মতোই।