একেবারে সাধারণ মানুষের গল্প। কোনও ঝাঁ চকচকে সেট আপ নেই, বিদেশে শুটিং নেই এমনকি আইটেম নাম্বারে চটুল নাচও নেই। তবু সেই সিনেমা হাজার হাজার মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে। বিগত কয়েক মাসে বলিউডের এমন কিছু সিনেমাই স্রেফ মানুষের গপ্প বলেই ছাপিয়ে গিয়েছে সবকিছু। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
সিনেমার আসল উদ্দেশ্য কী? কেউ বলবেন সমাজের কথা বলা। কেউ বলবেন মানুষের বিনোদনের আয়োজন করা। কেউ আবার ইতিহাস খোঁজার মাধ্যম হিসেবে সিনেমাকে দেখতে চাইবেন। কোনওটাই ভুল নয়। তবে সিনেমা আসলে মানুষের কথা বলে। তাই তার ভাষা যত সহজ হবে ততই মানুষের হৃদয় ছোঁবে। সম্প্রতি বলিউডেও সেই ছাপ বেশ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে। ‘লাপাতা লেডিস’ থেকে ‘টুয়েলভথ্ ফেল’-এর মতো ছোট সিনেমাই যেন বড় স্বপ্ন দেখাচ্ছে বলিউডকে।
আরও শুনুন: নায়িকা ছিলেন মধুবালা, দেশের প্রথম প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সিনেমা কোনটি জানেন?
বলিউড সিনেমার ইতিহাস একদিনের নয়। ভারতীয় সিনেমার সঙ্গেই এই ইন্ডাস্ট্রির বেড়ে ওঠা। কাজেই সিনে জগতের যাবতীয় পরিবর্তন সবার আগে প্রত্যক্ষ করেছে বলিউড দুনিয়া। নির্দিষ্ট একটা গণ্ডিতে একে বেঁধে রাখাও অসম্ভব। দেশপ্রেম থেকে টানটান উত্তেজনায় ভরা ফ্যামিলি ড্রামা, ভারতীয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছে একের পর এক কালজয়ী সিনেমা। শুধু সিনেমা নয়, তার গান, নাচ সবেতেই ছিল ম্যাজিকের ছোঁয়া। তাইতো ষাটের দশকের বলিউড সিনেমার গান শুনে এখনও বালিশ ভেজায় সদ্য কলেজে পা রাখা তরুণী। তবে কালের নিয়মে বলিউড দুনিয়ায় বানিজ্যের রমরমা বেড়েছিল রীতিমতো। সিনেবোদ্ধাদের মতে এই বানিজ্যিকরণের গেরোয় নিজস্বতা হারাতে বসেছিল বলিউড। গল্পের চেয়েও মুখ্য হয়ে উঠেছিল বিনোদন। যার মাত্রাছাড়া প্রভাব পড়ে সিনেমার বাজেটে। কোনও সিনেমার বাজেটই কয়েকশো কোটির নীচে নয়। ব্যবসাও হচ্ছে কোটির ঘরেই। কোনওটা চূড়ান্ত সফল। কোনওটা ব্যর্থ। তবে এইসবকিছু ব্যবসার হিসাবে। সিনেমার মূল্য বিচার করলে সবই হয়তো কোনওমতে পাসমার্কটুকু জোটাতে পারবে। এর মাঝে ভালো কাজ হয়নি বললে ভুল হয়। তবে তা তেমনভাবে চর্চায় আসেনি। কিন্তু ওটিটির হাত ধরে কোথাও গিয়ে সেই বেড়াটুকু যেন কাটতে শুরু করেছে।
আরও শুনুন: নায়ককে শরীর দেখাতে হয় না, নায়িকাকে নগ্ন করেই লোক টানতে চায় সিনেমা, বলেছিলেন স্মিতা
সাম্প্রতিক কিছু সিনেমার কথাই ধরা যাক। বলিউডের বিচারে এইসব সিনেমাকে ছোট সিনেমার দলে রাখা হবে। কিন্তু দর্শকের ভালোবাসার বিচারে এইসব ছোট সিনেমাই ছাপিয়ে যাচ্ছে অনেক বড় সিনেমাকে। কয়েক মাস আগে প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় কিরণ রাও পরিচালিত ‘লাপাতা লেডিজ’ সিনেমাটি। একেবারে দুই সাধারণ মেয়ের গল্প। একজন পড়াশোনা করতে চায়। উগ্র পৌরষের শিকল থেকে মুক্ত হয়ে নিজের শর্তে বাঁচতে চায়। অন্যজন নিজের পরিচয়টুকু খুঁজে ফেরে। তার আসল ঠিকানা কোথায়, সেই খোঁজেই তার দিন গুজরান। সিনেমায় এই দুই মহিলার জীবনের গল্প কী অদ্ভুতভাবে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা বোঝার জন্য সিনেমাটি তিন চারবার দেখার প্রয়োজন নেই। এই সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে তেমন সাড়া ফেলতে না পারলেও, ওটিটির হাত ধরে মানুষের মনে রীতিমতো দাগ কাটতে পেরেছে। দর্শকদের কাছে এই কদিনে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে লাপাতা লেডিজ, যা অন্য অনেক বড় সিনেমাকে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে। শুধু এই একটা সিনেমা নয়। একইভাবে সকলের মনে দাগ কেটেছে ‘টুয়েলভথ ফেল’ সিনেমাটিও। প্রত্যন্ত এক গ্রামের পড়ুয়া, যার কাছে নকল করে পরীক্ষায় পাস করাই স্বাভাবিক ছিল, এ সিনেমা তাঁর গল্প বলে। এখানেও ঝাঁ চকচকে সেট নেই, বিদেশে শুটিং নেই, রয়েছে বলতে সাধারণ জীবনের গল্প। একবারে দ্বাদশ উর্ত্তীর্ণ হতে না পারা ছেলের আইএস অফিসার হওয়ার গল্প। এই সিনেমাও প্রথমদিকে ব্যবসায়িক সাফল্য পায়নি। কিন্তু ওটিটি রিলিজের পর ম্যাজিকের মতো সিনেমাটি সকলের পছন্দ হয়ে ওঠে। এমনকি অন্যান্য বড় সিনেমাকেও ওটিটি ভিউ-এর দৌড়ে পিছনে ফেলে দিয়েছে লাপাতা লেডিজ কিংবা টুয়েলভথ ফেল এর মতো দিনেমা। তালিকায় আরও কিছু সিনেমাও রয়েছে। যেগুলি বাজেটের বিচার মোটেও বড় নয়। তবে দর্শকদের ভালোবাসার বিচারে যথেষ্ট জনপ্রিয়। এর থেকেই হয়তো বলা যায়, বলিউড নিজের পুরনো পরিচিতি ফিরে পাচ্ছে। জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে তো বটেই, একইসঙ্গে সিনেমার উৎকর্ষতার বিচারেও। যা আগামীদিনে আরও প্রশস্ত হবে বলেই মনে করছেন সিনে বোদ্ধারা। কিং খানের ভাষায় বললে, “বড়ে বড়ে দেশোঁ মে, অ্যায়সি ছোটি ছোটি সিনেমা হোতি রেহতি হ্যায়, সেনোরিটা…”