খ্যাতির অভাব নেই। কিন্তু অভাব নিত্যদিনের। আজ বাদে কাল কী খাবেন, তাই জানেন না। তাই নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে রুজিরোজগারের চেষ্টা করছেন পদ্মশ্রী প্রাপক শিল্পী। কে ইনি? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
সম্মান আর খ্যাতি দুই-ই, দুহাত ভরে পেয়েছেন এই শিল্পী। সাধারণ মানুষ থেকে সরকার, কে না চেনে তাঁকে! একালের শ্রোতাদের কাছে তিনিই ফিরিয়ে এনেছেন বিরল বাদ্যযন্ত্র কিন্নেরা। আর তার স্বীকৃতি মিলেছে খোদ দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকেই। পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হয়েছেন শিল্পী। অবশ্য শুধু অভিজাত সাংস্কৃতিক বৃত্তেই যে তাঁর যাতায়াত, তাও কিন্তু নয়। হায়দরাবাদের বাসিন্দা দর্শনম মোগিলাইয়ার সাদা শার্ট, মান্ডু আর মেরুন শাল ঝোলানো চেহারা সকলেরই চেনা। পথে বেরোলে পায়ে পায়ে তাঁকে থমকে যেতে হয়, কেন-না চেনা অচেনা মানুষেরা এসে তাঁকে অভিবাদন জানিয়ে যান। কেউ সই চান তো কেউ আবার সেলফি তুলে রাখেন। সকলের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলতেও কোনও ক্লান্তি নেই ৬৯ বছরের এই শিল্পীর। কিন্তু দুর্ভাগ্য, কেবল অভিবাদনে তো পেট ভরে না। তার জন্য যে জিনিসটির নিতান্ত প্রয়োজন, সেই টাকাপয়সার দেখা বিশেষ মেলেনি কখনোই। তাই নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেই রোজকার রুটি জোগাড় করতে হয় বর্ষীয়ান শিল্পীকে।
আরও শুনুন: নারী-পুরুষ দ্বন্দ্ব নয়, শ্রম-সম্মান-মজুরির প্রশ্নেই উঠে আসছে শ্রমজীবী নারীর পৃথিবী
দর্শনম কেবল কিন্নেরা বাজান না, এ যন্ত্রকে কার্যত পুনর্জন্ম দিয়েছেন তিনি। ভারতের এই তারযন্ত্রটি গোটাকয়েক উপজাতি ও দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রচলিত। অনেকটা বীণার মতো এই বাদ্যযন্ত্র তৈরি হয় বাঁশ, লাউ আর মৌচাক দিয়ে। কিন্তু সেইসব সম্প্রদায়েও এখন আর এ যন্ত্র কেউ বাজান না। এই মুহূর্তে এ দেশের একমাত্র কিন্নেরা-বাদক এই শিল্পীই। এই বিশেষ বাদ্যযন্ত্রটি বাজাতে পারেন, এমন কোনও শিল্পীই এখন আর নেই। ফলে দর্শনমের পরে এর উত্তরাধিকার থাকবে কি না, তাও প্রশ্নের মুখে। শিল্পী অবশ্য নিজের ছেলেকে এ বিদ্যা শিখিয়ে যেতে চান। কিন্তু তার আগে মৃগী রোগে আক্রান্ত ছেলেকে সুস্থ রাখার জন্য যে ওষুধপত্রের প্রয়োজন, তা জোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁকে। উপরন্তু বাড়িতে আরও আটজন মানুষ তাঁর উপরেই নির্ভরশীল। নানারকম টুকরোটাকরা কাজ করেই তাদের অন্নসংস্থান করেন শিল্পী।
কথায় বলে, শিল্প বহুদিনের, বহু শ্রমের সাধনা দাবি করে। নিজের শিল্পকে সেই প্রাপ্য বুঝিয়ে দিয়েছেন বইকি দর্শনম। কিন্তু তাঁর শিল্প কি তাঁর ততটাই খেয়াল রেখেছে? না, সে কথা বোধহয় বলার উপায় নেই। সম্মান আর স্বীকৃতি দিলেও, বৃদ্ধ শিল্পীর খাবার জোগাড়ের বন্দোবস্তও তা দিয়ে হয়নি কখনও। যেমনটা এ দেশে ঘটেই থাকে। সত্যি বলতে দর্শনম মোগিলাইয়ার গল্পটা নতুনও নয়, আলাদাও নয়। এই যেমন ধরুন, অলিম্পিকে অংশ নেওয়া অ্যাথলিট সীতা সাহুকে যেমন ফুচকা বিক্রি করতে দেখা গিয়েছিল। বা পদকজয়ী দৌড়বিদ মিরাজ আলি দুধের গাড়িতে দুধের ক্রেট লোড করেন। এ সবই তাঁদের পেশা, তাঁদের জীবন চালানোর উপায়। দর্শনমও তাই-ই করেছেন। এখন বলে নয়, ২৫ বছর ধরে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করে চলেছেন তিনি। কিন্তু সে পথেও কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর খ্যাতি। ২০২২ সালে পদ্ম পুরস্কার পেয়েছেন দর্শনম। তাঁর পক্ষে রাজমিস্ত্রির কাজ পাওয়াও তাই দুরূহ।
সম্প্রতি দর্শনমের বাড়ির কাজ করার একটি ছবি সামনে আসে। তারপর খানিক নড়েচড়ে বসেছে সে রাজ্যের সরকার। শিল্পীর দুর্দশার কথা জেনে, তা মেটানোর আশ্বাস দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীও। এবার শিল্পীর অবস্থা খানিক ফেরে কি না, তাই এখন দেখার।