২৪ কেজি চা পাতা তুলে মহিলা শ্রমিক মজুরি পান দিনে মাত্র ২৫০ টাকা। চায়ে চুমুক দেওয়ার সময় সে কথা কি আমরা ভাবি? কর্মরত মহিলাকে কেনই বা প্রশ্ন করা হবে যে, ফিরতে কত রাত হয়? কিংবা বাচ্চাকে কে দেখছে? যে মহিলা ধান কাটেন, ভাতও রাঁধেন, জমির মালিকানা কি আদৌ তাঁর? প্রশ্নগুলো সহজ নয়। অস্বস্তিকর। তাই বোধহয় সচরাচর আমরা সেসবের মুখোমুখি হই না। এই পরিস্থিতিতেই যেন আয়না হয়ে উঠেছে নারীদিবস উদযাপন মঞ্চের পোস্টারগুলি। শ্রমজীবী মহিলার সমস্যার মূল প্রশ্নগুলি তুলে এনে তা যেন নাড়া দিচ্ছে আমাদের স্থবির ভাবনাজগৎকেই।
এই প্রকল্পের ভাবনা ও রূপায়ণ নিয়ে কথা বললেন রত্নাবলী রায় ও দোলন গঙ্গোপাধ্যায়। মুখোমুখি রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
ভারতে বেতনহীন গৃহশ্রমের পরিমাণটা ঠিক কত, জানেন? তথ্য বলছে, প্রতিদিন কোনও পুরুষ ঘরের কাজে সময় দেন মোটামুটি ৫০ মিনিট। আর সাধারণত কোনও মহিলার জন্য যতটা ঘরের কাজ বরাদ্দ, তা সারতে সময় লাগে অন্তত ৬ ঘণ্টা। তারপরেও, সে ঘর তাঁর নিজের হয় কি? তাঁর কোনও কথা বা কাজ গৃহকর্তার পছন্দসই না হলেই ঘর থেকে বার করে দেওয়ার নিদান আসতেই পারে, এ কথা জানেন এ দেশের অনেক মহিলাই।
আবার ধরুন, এই যে সেই মহিলা বাড়ির জন্য ভাত রাঁধছেন, ভাত বাড়ছেনও, তিনি কৃষকরমণী হলে দেখা যাবে, সেই ধান বোনা-রোয়া-কাটার কাজেও তিনি হাত লাগিয়েছেন সমান তালে। অথচ, ঘরের মতোই সেই জমিতেও তাঁর কোনও মালিকানা নেই। আর যাঁদের ক্ষেত্রে সে জমি পরিবারেরও নয়? স্রেফ দিনচুক্তি মজুরির হিসেবে যখন চাষের জমি বা কলকারখানায় কাজ করেন মেয়েরা? কতটুকু মজুরি মেলে তাঁদের, জানেন? চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভেবে নিন, ২৪ কেজি চা-পাতা তুলে মেয়েরা মজুরি পায় দিনে ২৫০ টাকা। খেতমজুর মহিলারা পুরুষ মজুরের সঙ্গে একই কাজ করেন, কিন্তু দৈনিক বরাদ্দ পুরুষের চেয়ে কম। পটলের খেতে ৬ ঘণ্টা কাজ করে মেয়েরা হাতে পান মাত্র ৫০ টাকা।
ভাবছেন, খামোখা এসব কথা বলার মানে কী? মানে তো আছেই। এখনও যে এই অবস্থাটাই জারি রয়েছে, এবং থেকেই যাচ্ছে, সে কারণেই তা নিয়ে কথা বলা দরকার বলে মনে করেছে নারী অধিকার নিয়ে কর্মরত তিনটি সংগঠন। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কর্মরত ‘অঞ্জলি’, মেয়েদের বিভিন্ন পেশায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার সংস্থা ‘আজাদ ফাউন্ডেশন’ এবং মহিলা সাংবাদিকদের সংগঠন ‘SAWM India’ একত্রে ‘নারী দিবস উদযাপন মঞ্চ’ নামে একটি মঞ্চ তৈরি করেছে। যার উদ্দেশ্য, শ্রমজীবী মেয়েদের সঙ্গে নিয়মিত কথোপকথন। তার ভিত্তিতেই সেই মেয়েদের অসুবিধা-অপ্রাপ্তির কথাগুলো একের পর এক পোস্টারের আকারে তুলে ধরছে এই মঞ্চ। মে মাসের পয়লা থেকে একত্রিশ তারিখ পর্যন্ত, প্রতিদিন এমনই একেকটি পোস্টার সামনে আনার কথা ভেবেছেন তাঁরা।
দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে মেয়েদের নিয়ে কাজ করার পরেও, এই বিশেষ প্রকল্পটি শুরু করার প্রেক্ষাপট কী ছিল? সে প্রসঙ্গে মঞ্চের তরফে দোলন গঙ্গোপাধ্যায় জানালেন, মেয়েদের গৃহশ্রমের দিকটি তো এ দেশে বরাবরই অবহেলিত। কিন্তু যে মেয়েরা সরাসরি আর্থিক পারিশ্রমিক পাওয়ার কাজেই নিযুক্ত, তাঁদের ক্ষেত্রেও বরাদ্দ সাংবিধানিক অধিকারগুলো অনেকসময়ই মান্যতা পায় না। আরও স্পষ্ট করে রত্নাবলী রায় বলছেন, যাঁরা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মহিলা, তাঁদের আখ্যান খুব একটা উঠে আসে না। কর্পোরেট সংস্থা, সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মরতাদের ক্ষেত্রে আইনি সুযোগসুবিধা নিয়ে যদিও বা চর্চা হয়েছে, কিন্তু চা-শ্রমিক কি নির্মাণ শ্রমিক মহিলাদের পরিস্থিতি ঠিক কেমন, সে কথা খুব ধারাবাহিকভাবে উঠে আসেনি জনপরিসরে। তাঁদের কথা শোনার জন্য, কলকাতার বুকে প্রাথমিকভাবে একটি সভার আয়োজন করেছিলেন রত্নাবলী-দোলনরা। যেখানে মহিলা শ্রমিক থেকে গিগ শ্রমিক, ক্যাবচালক থেকে আশাকর্মী, এমন নানা ক্ষেত্রের মেয়েরা নিজেদের কথা বলতে পারেন। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার সুবাদে অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা কর্মীদের যাপন তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যকে কীভাবে প্রভাবিত করছে, তা দেখার আগ্রহ বরাবরই ছিল, বলছেন রত্নাবলী। কিন্তু এই কথা বলার সূত্রে দেখা গেল, মূলত যে দাবিদাওয়াগুলি উঠে আসছে তা নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনের অধিকার। সেখানে তাঁর মনে হয়েছিল, তাঁর নিজের ভাবনাকে আপাতত পিছনে রেখে এঁদের সেইসব ধুলো-মাটির কথাকে সামনে এগিয়ে দেওয়াটাই বেশি জরুরি। কর্মী মেয়েদের সেইসব অধিকারের দাবি, তাঁদের না-পাওয়ার সেইসব কথাই এবার উঠে আসছে এই পোস্টারগুলিতে। যাতে বাকি মানুষদেরও এ কথা মনে করিয়ে দেওয়া যায়, তা নিয়ে সচেতনতা গড়ে ওঠে।
আজকের দিনে জনসংযোগের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া অবশ্যই একটা জোরালো হাতিয়ার। তাকে কাজে লাগাতে চেয়েই ভারচুয়ালি এই পোস্টার ক্যাম্পেনের সূত্রপাত। যেখানে একদিকে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে রক্ষণশীলতার একটা চর্চা এই সময়ে ক্রমে উসকে উঠছে, নারীর প্রতি অসম্মান বা বৈষম্যের কথা শুনলেই যুক্তিতর্কের অবকাশ না রেখে তাকে পুরুষবিদ্বেষের তকমা দেওয়া হচ্ছে; সেখানেই, তার সঙ্গেই ছড়িয়ে পড়ছে নারীদিবস উদযাপন মঞ্চের পোস্টারগুলি। যা হয়তো একটা প্রতিরোধের প্রয়াসের মতোই। যে নারীদিবসের উদযাপনকে পুঁজি ক্রমশ নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে শুরু করেছে, একে তার একরকম প্রত্যুত্তর বলাও চলে। রত্নাবলী যেমন বুঝিয়ে দিচ্ছেন, নারীর প্রতি বৈষম্যের প্রতিবাদ বা নারীবাদী আদর্শের চর্চাকে যাঁরা নারী বনাম পুরুষ দ্বন্দ্বে বদলে দেন, এবং এই দ্বন্দ্বকে জিইয়ে রাখতে চান; তা তাঁদের কোনও একভাবে সুবিধা দেয়। দোলন বলছেন, “নারীবাদ মানেই পুরুষদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, এ কথায় আমরা কোনও দিনই বিশ্বাস করি না। নারীবাদ আসলে সমস্ত বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে এবং সাম্যের পক্ষে সওয়াল করে।“ কিন্তু “যখন আমরা সমান মজুরির কথা বলছি, তখন পুরুষ বনাম নারীর কথা কিন্তু বলছি না। একধরনের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা এই ধরনের বৈষম্যের প্রকাশ হিসেবে সামনে আসে, তার কথা বলছি। অর্থাৎ কোথাও পূর্বানুমান করেই নেওয়া হচ্ছে যে মেয়েদের কম টাকা দিলেও চলে। সেই স্টিরিওটাইপগুলিকে ভাঙতে চেয়েছি”- বলছেন রত্নাবলী রায়।
বাঁধা গতকে নানাভাবেই ভাঙার কথা বলছে এই পোস্টারগুলি। টাটকা একটি পোস্টার যেমন বলেছে,
শুন লো শুন লো বালিকা
রাখ কুসুমমালিকা
কলম, কোদাল, স্টিয়ারিং ধর
তোরাই দেশের চালিকা
এও তো একরকমের ছক ভাঙার ডাকই বটে। মেয়েরা কী কাজ করবে আর মেয়েরা কী কাজ করতে পারে, সে ছক সমাজ বেঁধে দেয়। ক্রমশ সে ছক মেয়েদের মাথার ভিতরেও বাসা বাঁধে। অনেক কর্মরতা মহিলাই যেমন আক্ষেপ করে জানান, কর্মক্ষেত্রে নিজেদের প্রমাণ করার জন্য অনেকসময়ই বেশি পরিশ্রম করতে হয় তাঁদের, নিতে হয় বেশি দায়িত্ব পালনের ভার। মেয়েদের দিয়ে কাজ হবে না, এমন পূর্বানুমান বাসা বেঁধে আছে যে! কিন্তু কাজ তো কেবল এখানেই শেষ হয় না। এখনও অধিকাংশ বাড়িতে ঘরের কাজের দায়িত্ব অলিখিতভাবে বর্তায় মেয়েদেরই উপর। সাহিত্যিক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদস্থ আধিকারিক যশোধরা রায়চৌধুরী এ প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, দুই বর্ষীয়ান আত্মীয়ার কথোপকথন শুনে ফেলেছিলেন তিনি। যাঁরা আক্ষেপ করছিলেন, বউ অফিসার না হয়ে কেরানি হলে তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে আসত। মেয়েদের কাজ থেকে বাড়ি ফিরতে রাত হলে যে বাঁকা চোখেরা গায়ে বেঁধে, তাদের কথাও বলেছে একটি পোস্টার। এমনিতেই এখনও বেশিরভাগ বাড়িতেই কাজে বেরনোর আগে বা পরে ঘর গোছানো থেকে সন্তানের দায়িত্ব পালন- এর একটা বড় অংশ, কখনও কখনও আবার সবটাই যে মেয়েদের উপরেই ন্যস্ত, সে কথা অস্বীকার করার জো নেই। মেয়েদের এই সামগ্রিক কর্মী সত্তার প্রাপ্য অধিকারের কথাই বলছে এই পোস্টারগুলি। সে বাজারে সবজি বিক্রি করতে আসা মহিলার জন্য শৌচাগার হোক কিংবা অফিসের আধিকারিক মহিলার শিশুকে রাখার জন্য ক্রেশ- সব শ্রেণির সব পরিসরের কর্মরতা নারীদের অবস্থাকেই তুলে ধরতে চাইছে পোস্টারগুলি।
এই প্রসঙ্গে এ প্রশ্নও আসে যে, নারীভাবনা যে সাম্প্রতিক সময়ে বারবার আহত হচ্ছে, তার নেপথ্যে কি সমসময়ের রাজনীতির ভূমিকা আছে? অর্থাৎ যে ধরনের রাজনৈতিক চিন্তা থেকে মুক্তচিন্তার চর্চা হয়, যা নারীর প্রশ্নগুলোকে গুরুত্ব দেয়, সেখানেই কি ঘাটতি থেকে যাচ্ছে? রত্নাবলী রায় বলছেন, রাজনীতিবিদদের একটা বড় ভূমিকা তো থাকছেই। যে ধরনের কুকথা বলার অভ্যাস এখন আমরা দেখছি, এবং তা বলে পার পেয়ে যাওয়া যাচ্ছে, তা সব নারীর প্রতিই অসম্মানকে একরকম মান্যতা দিচ্ছে।
প্রশ্নগুলো অবশ্য কেবল পোস্টারেই থেমে থাকবে না। এর ফলিত প্রয়োগের কথাও যে তাঁরা ভেবেছেন, সে কথা জানালেন দোলন গঙ্গোপাধ্যায়। তার আগে এই পোস্টার মিছিল যে অজানা কিংবা কম-জানা কথাগুলিকে সামনে নিয়ে এল, একইসঙ্গে একটা সুস্থ তর্কের পরিসর তৈরি করল; তাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সহনাগরিকের অপ্রাপ্তি, অসম্মানকে যেখানে স্বীকার না করার চর্চা চলছেই, সেখানে এই প্রতিরোধটুকুই বা কম কী!