বয়সের রেখা পেরিয়ে এল ১১৬ বছর। তবু কলমের আঁচড়ে জেগে রয়েছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। অসংখ্য গল্প-উপন্যাসে যে পৃথিবী তিনি গড়েছিলেন, তা এখনও, একইরকম জীবন্ত। সময়ের ফলায় তাতে কোনওরকম ফাটল ধরেনি। জন্মদিনে লেখককে ফিরে দেখলেন বিশ্বদীপ দে।
ছোট্ট ছেলেটাকে আদর করে ডাকা হত ‘কালো মানিক’ বলে। বাবা নাম রেখেছিলেন প্রবোধকুমার। কিন্তু সেই নাম নয়, বরং আদরের ডাকনামই শেষমেশ টিকে গেল। তবে প্রথম অংশটি ত্যাগ করে। তিনি হয়ে গেলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। কী আশ্চর্য সমাপতন! পরবর্তী কালে সেই মানুষটিই যে হবেন বাংলা সাহিত্যের এক অপূর্ব মাণিক্য। ১১৬ বছর বয়স হল তাঁর। অথচ বইপাড়ায় গেলে আজও দেখা যাবে নবীন কোনও পাঠক টিউশনির পয়সা জমিয়ে শতাব্দী পেরিয়ে আসা মানুষটিরই বই কিনছে। অসংখ্য গল্প-উপন্যাসে যে পৃথিবী তিনি গড়েছিলেন, তা এখনও, একইরকম জীবন্ত। সময়ের ফলায় তাতে কোনওরকম ফাটল ধরেনি!
উপমহাদেশের উপরে ঔপনিবেশিকতার প্রভাব, আধুনিক মানুষের সংকট, নিজের প্রবৃত্তির কাছে অমৃতের পুত্রের অসহায়তাকে তিনি যেভাবে ছুঁয়েছিলেন, তেমন করে কজনই বা পেরেছেন! জীবদ্দশাতেই তিনি বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্যের এক অনন্য শৃঙ্গ। পাঠক যে লেখনীর সামনে চিরপ্রণত।
কিন্তু তাঁর কথা বলতে বসলে বিষাদরেণু ছড়িয়ে যাবেই তাঁর মৃত্যু। জন্মদিনও এর ব্যতিক্রম নয়। অবধারিত ভাবেই স্মৃতিতে ভেসে আসেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ‘ফুলগুলো সরিয়ে নাও,/ আমার লাগছে।/ মালা জমে জমে পাহাড় হয়/ ফুল জমতে জমতে পাথর। /পাথরটা সরিয়ে নাও, আমার লাগছে।‘- এই কবিতা সেই কবে পড়েছি আমরা। আর অব্যবহিত পরেই জেনে গিয়েছি এই কবিতা লেখার পিছনের ঘটনা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরে তাঁর শরীর ভরে উঠেছিল ফুলে ফুলে। বলা হয়, ফুলের মালার চাপে নাকি খাটের পায়ায় চিড় ধরে গিয়েছিল! অথচ মানিককে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় সুভাষ মুখোপাধ্যায় যখন লেখকের স্ত্রীকে প্রশ্ন করেছিলেন, কেন আরও আগে তাঁদের খবর দেওয়া হয়নি, তখন তিনি বেদনামাখা কণ্ঠস্বরে বলেছিলেন, সেটা করতেও পাঁচ আনা খরচ হয়। দারিদ্রের ছোবল কতটা গভীর পর্যন্ত চারিয়ে গিয়েছিল, এই একটি উচ্চারণ থেকেই স্পষ্ট।
মানিক লিখেছিলেন, ‘বই কেন ভালোবাসি? মানুষকে ভালোবাসি বলে।’ অথচ নিজের জীবনে মানুষের ভালোবাসার যে নমুনা পেয়েছিলেন তা যেন সেই অনুভবের একেবারে বিপ্রতীপে। প্রথম যেবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, সেকথা ডায়রিতে লিখতে গিয়ে ঝরে পড়েছে অভিমান। তিনি অবাক হয়ে দেখেছিলেন, তাঁকে ভর্তি করিয়ে দিয়েই একে একে সরে পড়েছেন বন্ধু, নিকটজনেরা। লক্ষ করলেন, পাশ থেকে সরে যাচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টিও। যদিও এই অভিমান সবক্ষেত্রে যে সঠিক, তা নয়। কেননা সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, প্রসূন বসুর মতো পার্টি সদস্যরা কিন্তু ছিলেন। ছিলেন দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। আবার হাসপাতালে ভর্তি করার পিছনে রয়েছে জ্যোতি বসুর উদ্যোগ। কিন্তু যে মানুষ জ্যোৎস্নারাতে আপনমনে বাঁশি বাজান, চরাচর জুড়ে ছড়িয়ে দেন মৌতাত, তাঁর হৃদয়ের পাত্র এত সহজে কি পূর্ণ হতে পারে? এত বড় একজন সাহিত্যিক, অথচ অর্থাভাব তাঁকে দিয়ে বলিয়ে নিয়েছিল, ”দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায়।” এই অভিমান মৃত্যুর সমীপে তাঁকে আরও একা করে দিয়েছিল। তাই শেষ অবস্থায় নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইছিলেন কমরেডদের থেকেও। বাড়তে বাড়তে আকাশ ছুঁয়েছিল অভিমান। ছোটবেলায় কুস্তি লড়তেন। একা হাতে লড়ে যেতে জানতেন অনেকের সঙ্গে। কিন্তু ততদিনে অসুখ তাঁর আত্মবিশ্বাসকে কুরেকুরে খেয়ে ফেলেছে। সেই জায়গা নিয়েছে অনন্ত অভিমান।
অথচ মৃত্যুর পরে সেই মানুষটিকে দেখতে ভেঙে পড়েছিল শহর। বন্ধ রাখা হয়েছিল বরানগর পুরসভা। সাধারণ মানুষ, রাজনীতিবিদ, নামী সাহিত্যিক ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের ভিড়ে তিনি তখন শোকের এক প্রগাঢ় ছায়া হয়ে ঢেকে ফেলছেন সূর্যের দীপ্তিকেও! কিন্তু শোক ও অশ্রুর এমন বিপুল সংস্রব জীবদ্দশায় কল্পনাও করেননি মানিক। পৃথিবী ছেড়ে অনন্তের পথে পাড়ি দিয়েছেন জ্যোৎস্নাভেজা মনকেমন বাঁশির সুরে। কিন্তু কোথায় আর গিয়েছেন তিনি! ফিরে ফিরে আসেন যে আজও। কেবল নিজের জন্মবার্ষিকীতেই নয়। কোনও পাঠকের মননকে যখন আলোড়িত করতে থাকে তাঁর লেখা, এই পোড়া বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন ঘটে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কেননা শরীর পুড়ে গেলেও লেখা থেকে যায়। পাণ্ডুলিপি কখনও পোড়ে না।