মৃণাল সেনকে চেনার প্রক্রিয়া প্রশ্নাতীত নয়, ভক্তি কিংবা স্তব-স্তুতিও নয়। এমনকী, একজন মেধাবী মানুষের মেধার দিকগুলিকে তুলে ধরে অবতার গড়ে তোলার মধ্যেও কোনও সার্থকতা নেই। বরং সেই সার্থকতায় পৌঁছনো যায়, যদি তাঁকে একটু দূরত্ব থেকে দেখা যায়। তাঁর মত-পথ নিয়ে যদি একটা ডিসকোর্স ঘনিয়ে তোলা যায়, তবে সেই ব্যক্তির ভাবনার আর-একটু কাছাকাছি পৌঁছনো যায়।
মৃণাল সেন ফিরে এলেন, ঠিক যেভাবে তাঁর ফিরে আসার কথা ছিল। এমন নয় যে, বৌদ্ধিক বাঙালিমানসে তিনি মিলিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর সিনেমা ছিল হাতের কাছেই। সে ছবি দেখার মতো রসিক মানুষও ছিলেন। সিনেমাশিল্পে বাঙালি যে ত্রয়ীকে প্রায় মাথায় করে রাখে, তাঁদের মধ্যে তিনি একজন। তবে, একজন শিল্পীকে তো দেখা উচিত প্রশ্ন ও দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়েই। সময়ের প্রেক্ষিতে যদি একজন শিল্পীকে চিনে নিতে হয়, তবে সে-চেনার পথ এগিয়ে যায় সময়ের চরিত্র মেনেই। এই চেনার প্রক্রিয়া প্রশ্নাতীত নয়, ভক্তি কিংবা স্তব-স্তুতিও নয়। এমনকী, একজন মেধাবী মানুষের মেধার দিকগুলিকে তুলে ধরে অবতার গড়ে তোলার মধ্যেও কোনও সার্থকতা নেই। বরং সেই সার্থকতায় পৌঁছনো যায়, যদি তাঁকে একটু দূরত্ব থেকে দেখা যায়। তাঁর মত-পথ নিয়ে যদি একটা ডিসকোর্স ঘনিয়ে তোলা যায়, তবে সেই ব্যক্তির ভাবনার আর-একটু কাছাকাছি পৌঁছনো যায়। বর্তমান সময়ে শিল্পী মৃণাল সেনকে কীভাবে দেখতে হবে, তাই যেন শিখিয়ে দিলেন অঞ্জন দত্ত, তাঁর ‘চালচিত্র এখন’ ছবিতে।
ছবিটির প্রাথমিক পরত অবশ্যই মৃণাল-অঞ্জন সম্পর্কের ইতিকথা। তবে, ছবিটি সেখানেই শুধু সীমাবদ্ধ হয়ে থাকে না। বরং তরুণ অভিনেতা রঞ্জন (অঞ্জন দত্তের আদলে নির্মিত চরিত্র) একদা যে-প্রশ্ন, যে-দ্বিধা নিয়ে কুণাল সেনের কাছে (মৃণাল সেনের আদলে নির্মিত চরিত্র) হাজির হয়েছিলেন, তা যখন উঠে আসতে থাকে, তখন আদতে সময়ের সংশয়ের কুয়াশাগুলিই একটু একটু করে কাটতে থাকে। ব্যক্তি ও সমষ্টির সেই চিরায়ত সম্পর্ক ও দ্বন্দ্বের নিবন্ধ আর একবার লেখা হতে থাকে চলচ্চিত্র মাধ্যমে। সমষ্টির ভূমিকার প্রতি প্রশ্নহীন বিশ্বাস রঞ্জনের নেই। বরং তিনি অনেকটাই সার্ত্রপন্থী। মার্কসবাদী ধারণার পিরামিডটিকে যেভাবে উলটে দেখার পক্ষপাতী ছিলেন সার্ত্র, যেখানে ব্যক্তি একেবারে অবলোপ হয়ে যায় না; এই মত তাঁর কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। কিন্তু তাঁর পরিচালক কি সেই পথে বিশ্বাস করেন? প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বাস করার দরকারও কি আছে? ছবিটি দেখায়, ব্যক্তি ও সমষ্টির দ্বন্দ্বে পরিচালক তাঁর নিজের বিশ্বাসেই থিতু। তবে সেই মত তিনি তাঁর তরুণ অভিনেতার ভাবনাজগতে চাপিয়ে দিচ্ছেন না। অর্থাৎ এই সম্পর্কে ক্ষমতার নিরিখে উপরের দিকে থাকা সত্ত্বেও তাঁর আগ্রাসন নেই। বরং তরুণ অভিনেতা তাঁকে নির্দ্বিধায় এই নিয়ে বহু প্রশ্ন করতে পারেন; হিটলার থেকে স্তালিনের ইতিহাস তুলে এনে তাঁর মনের দ্বিধা সংশয় প্রকাশ পারেন খোলাখুলিই। এবং আরও স্পষ্ট করে বলতে পারেন যে, কমিউনিস্ট হওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তাতে কী! পরিচালক কি তাঁকে কমিউনিস্ট হিসাবে চেয়েছেন, নাকি অভিনেতা হিসাবে? একজন ভালো অভিনেতা বলেই রঞ্জন তাঁর ছবিতে সুযোগ পেয়েছে, তিনি কমিউনিস্ট কি-না, কমিউনিস্ট হতে পারবেন কি-না, তা এখানে বিবেচিত নয়।
অর্থাৎ শিল্প-শিল্পী এবং মতাদর্শের ভিতরকার যে সম্পর্ক ও দ্বন্দ্ব, তাও উন্মোচিত হয় একজন পরিচালক ও তাঁর অভিনেতার কথোপকথনে। ছবিটির একটি পর্যায়ে দেখা যায় যে, রঞ্জনের বন্ধু পরিচালক কুণাল সেনের সমালোচনায় মুখর। বলছেন, নিজের প্রতিটি ছবিতে তিনি যেন নিজেকেই কনট্রাডিক্ট করছেন। এই অবস্থানকে সুবিধেবাদী বলেই মনে হয় সেই তরুণের। আর এখানেই ছবিটি ছুঁয়ে ফেলে সমসময়কে। সমসময়ের একজন দর্শক উপলব্ধি করতে পারেন, নিজেকে, নিজের দর্শনকে সমালোচনা করে যাওয়া ভুল কিছু নয়। বরং তা জরুরি। মতাদর্শের দলীয় কাঠামো হয়তো তা সমর্থন করে না। তবে, মতাদর্শ তো কেবল দল নয়। বরং এই আত্মসমালোচনার পরিসরই একটি দর্শনকে কালোত্তীর্ণ করে। যে গুণে সময়ের নিগড় থেকে মুক্ত হয়ে যায় সৃষ্টি এবং তাঁর স্রষ্টাও। সময়ের ধুলোবালি সরিয়ে তা অনেকখানি এগিয়ে যায় মহতের দিকে। অনড় অবস্থান শিল্পের নয়, শিল্পীর তো নয়-ই। বরং যে চলিষ্ণুতা জীবনের ধর্ম, তাই-ই শিল্পীর উপাস্য। তাই নিজেকে সমালোচনার অধিকার তাঁর আছে, এবং তিনি তা করবেনই। একই সঙ্গে তরুণ দৃষ্টি ইতিহাসকে যেভাবে দেখতে চাইছে, তার সময়কে যেভাবে বুঝে নিতে চাইছে, তাকেও তিনি অস্বীকার করেন না। এই দ্বান্দ্বিক বাস্তবতাই শিল্প ও শিল্পীকে এগিয়ে দেয় সেইদিকে, যেদিকে ব্যক্তি-সমষ্টি পেরিয়ে জেগে থাকে জ্যান্ত মানুষের ভুবন। শিল্পের সেই চালচিত্র তাই পুরনো হয় না।
পরিবর্তনের ধর্মকে স্বীকৃতি দিতে জানেন বলেই কুণাল সেনের দরকার পড়েনি তাঁর তরুণ অভিনেতা রঞ্জনের মগজধোলাই করার। বরং বার্লিন পালানোর জন্য উন্মুখ এক যুবককে তিনি ধরিয়ে দিয়ে ছিলেন কলকাতার নেশা। পৌঁছে দিয়েছেন মানুষের বিক্ষত বাস্তবতার দিকে। শিল্পীর গন্তব্যে তিনি হাত ধরে পৌঁছে দেওয়ার পক্ষপাতী নন। তবে, রাস্তা যে কেবল একমুখী নয়, সেটুকু তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন প্রায় কিছু না বলেই। বাকিটা? তরুণ রঞ্জন যে অঞ্জন দত্ত নিজেই, এটুকু সমীকরণ মিলিয়ে নিয়েই দর্শক বুঝতে পারেন, কুণাল সেন বা মৃণাল সেনের শিল্পীসত্তার রাজনৈতিক বাস্তবতা। মজার বিষয় হল, সেই একই পথ ধরে এ ছবিতে পরিচালক অঞ্জন দত্ত নিজেও কিছু দাগিয়ে দিয়ে বলতে চান না। একদিক থেকে বলতে গেলে, এ ছবি তো তাঁর ব্যক্তিগত দিনপঞ্জী- তাঁর মনের নিকটতম লেখা। তবে, উত্তরকালকে তিনি কিছু বার্তা দিচ্ছেন না। শুধু বলছেন, এক প্রশ্নমুখর তরুণ মন কীভাবে তাঁর পূর্বসুরির সামনে আসতে পারে। নিজেকে প্রকাশ করতে পারে এবং পূর্বসূরিকে বুঝে নিতে পারে। সেখানে প্রশ্ন থাকে, প্রতর্ক থাকে, রাজনৈতিক মতভেদ থাকে। থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। বরং না-থাকাটাই অস্বাভাবিক। একরৈখিক যে কোনও সম্পর্কই আসলে আখেরে মৌলবাদে গিয়ে শেষ হয়। তার কি দরকার আছে? নাকি, সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ভিতর জাগ্রত যে ভালো, তার সন্ধানে নামলেই নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তার অভিমুখ মেলে! প্রশ্নটাকে ছবি জুড়েই ঘুরপাক খাইয়ে দিয়েছেন অঞ্জন। আর সেটাই মৃণাল সেনকে চেনার সোপান। এমনকী নিজেদেরও। প্রশ্নহীন অবতারবাদ থেকে দর্শককে বের করে এনে মৃণাল সেনকেই জীবন্ত টেক্সট করে তুলেছেন অঞ্জন। ছবিটি তাঁকে পাঠের ধরতাই মাত্র, মৃণাল সেনের সঙ্গে রাজনৈতিক বহেস জমিয়ে তোলার দায়িত্ব তরুণ দর্শকেরই। মৃণাল সেনের জন্মদিনে সেটাই বোধহয় সবথেকে জরুরি কাজ।