বাঙালির স্থাবর সম্পত্তিতে আর কিছু থাক বা না থাক, রবীন্দ্ররচনাবলি থাকবেই। অন্তত কয়েক খণ্ড। যেমন সিন্দুকে তোলা থাকে পূর্বপুরুষের মহার্ঘ জিনিস। বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া তা বের করা হয় না। ‘সোনার জলে দাগ পড়ে না, খোলে না কেউ পাতা’। তবে আছে যে, সেটুকু জেনেই শান্তি। এমনিতে বাঙালির হাতে সময়ের টানাটানি। সিনেমা, গান, নাচ, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, কবিতা, গল্প, উপন্যাস- সংস্কৃতির বিবিধ অলিগলিতে বাঙালিকে নিরন্তর এত যাতায়াত করতে হয় যে, অত খণ্ড রবীন্দ্রনাথ আর ধরে ধরে পড়া হয় না। মলাটবন্দি সেই রবীন্দ্রনাথকে ফিরে দেখলেন সরোজ দরবার।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে হয়েছে বড্ড মুশকিল। সেই যখন ছোটখোকা শেখেনি কথা কওয়া, তখন থেকেই তিনি বাঙালিকে পাকড়াও করে বসে আছেন। বোঝা, না-বোঝার অগম পারে রবীন্দ্রনাথ কোনও না কোনোভাবে থেকেই যান। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমুক কবিতা আবৃত্তি দিয়ে বাঙালির যে রবীন্দ্র-যাপন শুরু হয় শৈশবে, তা চলতে থাকে জীবনভর। ইস্কুলে, পাড়ার ক্লাবে বার্ষিক রবীন্দ্রপুজো। পঁচিশে বৈশাখের সকালে চন্দন, মালা, ফুল। রবীন্দ্রসংগীত, রবীন্দ্রনৃত্য। পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ। পরীক্ষায় রবীন্দ্রনাথ। আর একটু বয়স গড়ালে প্রেমে রবীন্দ্রনাথ। ভাঙা প্রেমে রবীন্দ্রনাথ। সব মিলিয়ে ব্যাপারটা দাঁড়ায় গিয়ে এই যে, ‘কাজিফুল কুড়োতে কুড়োতে জড়িয়ে গেলি মালায়/ হাত ঝুমঝুম পা ঝুমঝুম এক ঠাকুরের জ্বালায়’।
আরও শুনুন:
ডাকলে বাঙালি যে ঠাকুরের দেখা পায়, তিনিই রবীন্দ্রনাথ
এই করতে করতে রবীন্দ্রনাথ ভারি চেনা হয়ে যায় বাঙালির। যত দিন যায় বাঙালি গোটাকয় নিত্যসত্য আয়ত্ত করে নেয়। যেমন, রবীন্দ্রনাথ হলেন নিভৃত প্রাণের দেবতা। তিনি প্রাণের আরাম আত্মার শান্তি। তিনি জড়িয়ে আছেন আমাদের জীবনের প্রতি মুহূর্তে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কেন যে তিনি জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছেন, তার হদিশ মেলে না। নিজেদের মতো করে একখানা ছোটখাটো রবীন্দ্রনাথ বানিয়ে নিয়ে আমরা ঘুরে বেড়াই। এদিকে বাড়ির সবথেকে উঁচু তাকে রাখা সার সার রচনাবলি। নানা সংস্করণ। ওটুকু না থাকলে বাঙালিবাড়ির মান থাকে না। বাঙালির স্থাবর সম্পত্তিতে আর কিছু থাক বা না থাক, রবীন্দ্ররচনাবলি থাকবেই। অন্তত কয়েক খণ্ড। যেমন সিন্দুকে তোলা থাকে পূর্বপুরুষের মহার্ঘ জিনিস। বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া তা বের করা হয় না। তবে আছে যে, সেটুকু জেনেই শান্তি। অতএব রবীন্দ্ররচনাবলিরও আর পাতা ওলটানো হয়ে ওঠে না। এমনিতে বাঙালির হাতে সময়ের টানাটানি। সিনেমা, গান, নাচ, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, কবিতা, গল্প, উপন্যাস- সংস্কৃতির বিবিধ অলি-গলিতে বাঙালিকে নিরন্তর এত যাতায়াত করতে হয় যে, অত খণ্ড রবীন্দ্রনাথ আর ধরে ধরে পড়া হয় না। তার উপর কম তো লিখে যাননি। হেন প্রসঙ্গ নেই, যেখানে রবীন্দ্রভাবনার ছায়া পড়েনি। অতএব দরকার পড়লে নিশ্চয়ই খুঁজে দেখা যাবে, এই ভেবে রবীন্দ্ররচনাবলি তুলে রাখা থাকে বাঙালির সাংস্কৃতিক কুলুঙ্গিতে। রবীন্দ্রনাথ ফলত থেকে যান বন্ধ মলাটের ভিতর, আর বাঙালির হাতে থাকে পেনসিল।
এই করে অবশ্য দিব্যি চলেও যায়। পঁচিশে বৈশাখ আসে যায়। হাতে গোনা কটা গানে গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো সারা। তাই বলে কি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকেছে! এমন বদনাম কেউ দিতে পারবে না। বাঙালি তাঁকে যে একেবারে পড়ে না, এমনটা নয়। পড়ে উদ্ধৃতির ঘেরাটোপে। ঘর হতে দু-পা ফেলারও দরকার নেই, ঘরের ভিতর বসে দু-চোখ মেললেই দেখা যায়, উদ্ধৃতির ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। বলতে গেলে প্রায় যে কোনও লেখার ভিতরই তিনি চলে আসেন অনিবার্য। আর সেখানেই বাধে গোলমাল। এই লেখা চায় রবীন্দ্রনাথকে একরকম করে ব্যবহার করতে। ওই লেখা চায় রবীন্দ্রনাথকে আর একরকমের করে কাজে লাগাতে। কেউ যদি বলেন তিনি পুবের সাধনার ধনকে বিলিয়ে দিয়েছেন আগামী পৃথিবীর জন্য, তাও ঠিক। আবার কেউ যদি বলেন তিনি পশ্চিমের আধুনিকতার রথে চড়ে বসেছেন, তাও একেবারে ভুল নয়। গান্ধীর জন্য আছেন রবীন্দ্রনাথ, সুভাষের জন্যও। চাইলে তাঁকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পক্ষে দেখা যায়, আবার স্বাধীনতার জন্য লোক খ্যাপানোর পদ্ধতির সমালোচক হিসাবেও দেখা যায়। চাইলে বর্তমানের যে কোনও রাজনৈতিক দল তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য এক আঁজলা রবীন্দ্রনাথ তুলে এনে দিতে পারেন সমর্থকদের সামনে। তিনি ভারততীর্থেও আছেন, রাশিয়ার চিঠিতেও আছেন। তিনি শাস্ত্রেও আছেন, শাস্ত্র পেরিয়ে যাওয়ার সাহসেও আছেন। তিনি সকলকে সঙ্গে নিয়ে আছেন, আবার একলা চলোতেও আছেন। এই বেধে গেল মুশকিল। উদ্ধৃতি ছেনে ছেনে দিনে দিনে যেন ভাঙা ভাঙা অনেক রবীন্দ্রনাথ এসে জমা হয় আমাদের সামনে। আর আমরা, বাঙালিরা এই ধাঁধায় পড়ে যাই যে, এতদিনের চেনা সেই রবীন্দ্রনাথ আসলে তাহলে কে?
বহুদিন ধরে বহুক্রোশ ঘুরে আসার পর একদিন আমরা বুঝতে পারি, রবীন্দ্রনাথকে আসলে আমরাই ডাকঘরের অমল করে রেখেছি। যেন তাঁর বইয়ের তাকে বন্দি থাকাই নিয়তি। সেখান থেকে বেরোতে মানা। অথচ মানা তো ছিল না। বরং ছিল জানার সুযোগ। যদি জানতেম, তাহলে আর রবীন্দ্রনাথে আমাদের ধাঁধা মনে হত না। স্ববিরোধীও মনে হত না। বরং তাঁকে সমগ্রতায় জানার ভিতর দিয়েই আমরা খুঁজে পেতাম নিজের এগিয়ে যাওয়ার পথ। উদ্ধৃতির ঘেরাটোপে তাঁকে পড়া আসলে আটকে পড়া রবীন্দ্রনাথ। আমরাই তাঁকে ঠেলে দিয়েছি সেই দিকে। অথচ তিনি দুয়ার খুলেই রেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে ধারাবাহিক পড়া জরুরি। তা না হলে বাঙালি নিজেও আদতে ওই ঘরবন্দি অমলই হয়ে ওঠে। চারুলতার ঝড় হয়ে আসা অমল আর তার হয়ে ওঠা হয় না। অথচ কী সৌভাগ্য যে, নিজের ভাষায় তাঁকে পড়া, জানা, শোনার সুযোগ শুধু বাঙালিরই আছে।
আরও শুনুন:
ঈশ্বরের আসনে যেন না বসানো হয়, জন্মদিনে এটাই ইচ্ছা ছিল রবীন্দ্রনাথের
সে সুযোগ যদি হাতছাড়া না করা হয়, তবে কোন এক সকালে হয়তো আমরা উপলব্ধি করব, আমাদের মুক্তি রবীন্দ্রনাথের আলোয় আলোয়। আর সেদিন যে তারিখই হোক না, বাঙালির কাছে তাই-ই আসলে পঁচিশে বৈশাখ।