চলতি ভোটের মরশুমে জোটের বাজার চড়া। বড় জয় পেলেও এর আগে একাধিক দলের সঙ্গে জোট বেঁধে তবেই সরকার গড়েছে বিজেপি। এবার তাদের এনডিএ সরকারের মোকাবিলা করার জন্যই ইন্ডিয়া জোটে নাম লিখিয়েছিল বিরোধীরা। তবে ভারতের রাজনীতিতে এই জোটকীর্তন কিন্তু নতুন নয়। স্বাধীনতার আগে থেকেই জোট চিনেছে ভোট। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
একার যা জোর, বেঁধে বেঁধে থাকার জোর তার চেয়ে বেশি। এমনটা ভেবেই প্রবল প্রতিপক্ষ বিজেপিকে রুখতে লোকসভার আগে জোট বেঁধেছিল বিরোধীরা। অবশ্য ভোটের বাজারে ইন্ডিয়া জোটের টানাপোড়েনও প্রকাশ্যে এসেছে অনেকবারই। এদিকে জোটসঙ্গী কম নেই বিজেপিরও। তবে এহেন জোট বাঁধার চল তো নতুন নয়। সরকার গড়ার জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে বারে বারেই জোট বাঁধতে হয়েছে দলগুলিকে। রাজনীতির ময়দানে শক্তি বাড়াতে জোটযাত্রা চলছে স্বাধীনতার আগে থেকেই। এনডিএ সরকার গড়ার আগে পর্যন্ত এমন কী কী বড় জোটবন্ধন দেখেছে দেশ, ভোটের মরশুমে তা-ই দেখে নেওয়া যাক বরং।
আরও শুনুন:
ভোটের সাপলুডোয় কে জিতবে আপনার হাতেই? মোবাইলে চোখ রাখলেই কেল্লাফতে
ভারতের রাজনীতিতে জোটের কথা বলতে হলে প্রথমেই আসবে ১৯৪৬ সালের কথা। সেবার অন্তর্বর্তী সরকার গড়ে কংগ্রেস, প্রধানমন্ত্রী হন নেহরু। জোটসঙ্গী হিসেবে মন্ত্রিসভায় ছিলেন মুসলিম লিগ-এর লিয়াকত আলি ও যোগেন মণ্ডল, হিন্দু মহাসভা-র ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও কে. সি. নিয়োগী, জাস্টিস পার্টি-র বি. আর. আম্বেদকর, শিখ সমাজ থেকে বলদেও সিং এবং রাজন্যবর্গের প্রতিনিধি হিসেবে রাজকুমারী অমৃতা কউর। এর পরের বছরই স্বাধীনতা পেল দেশ। প্রথম জাতীয় সরকারে প্রধানমন্ত্রী নেহরু ছাড়াও ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ, আম্বেদকররা।
এরপর ১৯৭৭ সালে আবার মেজর জোট গঠন দেখে দেশ। আদি কংগ্রেস, জনসংঘ, ভারতীয় লোকদল, ভারতীয় ক্রান্তিদল, কংগ্রেস ফর ডেমোক্রেসি, কংগ্রেস সোশালিস্ট ও সোশালিস্ট পার্টি মিশে গিয়ে গড়ে ওঠে ‘জনতা পার্টি’। মোরারজি দেশাই-এর প্রধানমন্ত্রিত্বে এই জনতা সরকার টিকে ছিল সোয়া দু’বছর। ১৯৭৯-এর মিলিজুলি ফ্রন্টের আয়ু অবশ্য তিন মাসও পেরোয়নি। ভারতীয় ক্রান্তি দলের নেতা চৌধুরী চরণ সিং ‘গণতান্ত্রিক মজদুর বিকাশ পার্টি’ নামে নতুন দল গড়ে প্রধানমন্ত্রীর তখতে বসেছিলেন। বাইরে থেকে সমর্থন দিয়েছিল কংগ্রেস ও বাম।
আরও শুনুন:
‘গরিবি’ হটিয়ে ‘আচ্ছে দিন’ এল কি? দশে মিলে দেশের রাজনীতি চেনাল স্লোগানেরা
১৯৮৯ সালে আবার ডি.এম.কে, তেলেগু দেশম, অসম গণপরিষদ, কংগ্রেস (সোশালিস্ট) প্রভৃতি দলকে নিয়ে জোট হয়। বাইরে থেকে সমর্থন দেয় বিজেপি ও বামদলগুলি। বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-এর প্রধানমন্ত্রিত্বে এই সরকার চলেছিল ১১ মাস। ১৯৯০ সালে নয়া জোট সমাজবাদী সরকার গড়লেও তা তিন মাস টিকেছিল মাত্র। এরপর ১৯৯৬ সালে ফের পালাবদলের প্রহসন দেখে দেশ। সেবার মাত্র ১৩ দিনের সরকার গড়েছিল মিনি এনডিএ। জোটের শরিক ছিল তেলেগু দেশম, শিবসেনা, অকালি দল প্রভৃতি।
১৯৯৬ সালেই প্রথমবার সরকার গড়তে জোটে যোগ দেয় কমিউনিস্টরা। দেবগৌড়ার নেতৃত্বে এই সরকারে সি.পি.আই ছাড়াও শরিক ছিল ডি.এম.কে, তেলেগু দেশম, লালু প্রসাদের রাষ্ট্রীয় জনতা দল, পাসওয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি, জনতা দল, সমাজবাদী পার্টি-সহ মোট ১৩ দল। কার্যত অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি আঞ্চলিক দলগুলির জোট। দেবগৌড়া ক্ষমতায় ছিলেন এগারো মাস, কিন্তু পরে কংগ্রেস বেঁকে বসার যুক্তফ্রন্টে নেতা বদল করা হয়। নতুন প্রধানমন্ত্রী হন ইন্দ্রকুমার গুজরাল। যুক্তফ্রন্ট ১ এবং যুক্তফ্রন্ট ২ বলে পরিচিত এই দুই জোট সরকার।
১৯৯৮-তে বিজেপি-র সঙ্গে ‘ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স’ বা এনডিএ-১ জোট বাঁধে অকালি দল, জর্জ ফার্নান্ডেজের সমতা পার্টি, এ. আই. ডি. এম. কে। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। কিন্তু জয়ললিতা সমর্থন প্রত্যাহার করায় সরকার ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়। পরের বছর, ১৯৯৯-তেই ক্ষমতায় আসে এনডিএ ২। ন্যাশনাল কনফারেন্স, অরুণাচল কংগ্রেস, মনিপুর পিপলস পার্টি-সহ ২৩ দল নিয়ে গড়া জোট সরকারের নেতৃত্ব দেন বাজপেয়ী।
আরও শুনুন:
দেওয়াল জোড়া প্রচার আছে, তবে বদল লিখনেই
২০০৪ সালে কার্যত এই প্রথম জোট সরকার গড়ে কংগ্রেস। ইউনাইটেড প্রোগেসিভ অ্যালায়েন্স বা ইউপিএ-র শরিক ছিল ১৫ দল। ২০০৯ সালে ফের ক্ষমতায় আসে ইউপিএ ২। সেখানে নতুন শরিক হয় তৃণমূল কংগ্রেস ও ঝাড়খণ্ড বিকাশ মোর্চা। দুবারই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং। এর মাঝে ২০০৮ সালে থার্ড ফ্রন্ট নামে জোট গড়ে এন.ডি.এ এবং ইউ.পি.এ-র বাইরে আটটি দল। নেতৃত্ব দিয়েছিল বামেরা। তবে সরকার গড়া তো দূরের কথা, ভোটেও একসঙ্গে লড়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি এই জোটের।
ইউপিএ সরকারকে সরিয়ে ২০১৪-তে ক্ষমতায় আসে এনডিএ সরকার। পরপর দুই পূর্ণ টার্ম ক্ষমতায় থেকেছে এই সরকার। আর চলতি নির্বাচনে ফের ভাগ্যপরীক্ষায় নেমেছে এনডিএ ও ইন্ডিয়া জোট।