গণতন্ত্র, যা আসলে প্রত্যেক মানুষের মতপ্রকাশের পক্ষে সওয়াল করে, সেই মতপ্রকাশেরই সর্বোচ্চ প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই ভোট ব্যবস্থা। তাই মনে করা হয়, সেই সমস্ত প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ আসলে জনতার হাতেই। সে নিজে মাঠে নেমে খেলতে যায় না বটে, কিন্তু খেলার রিমোট থাকে তারই হাতে। সেই ভোটের বাজারেই কিস্তিমাত নানারকম অনলাইন ভোট-গেমেরও।
খেলা হবে! বছর কয়েক আগেই ভোটের বাজারে ঝড় তুলেছিল এই স্লোগান। তা অবশ্য ছিল আদ্যন্ত রাজনৈতিক বক্তব্য। কিন্তু এই স্লোগানকে একটু অন্যভাবেও দেখা যেতেই পারে। কেবল রাজনীতির ময়দানেই তো খেলা হয় না, এখন খেলার ময়দানেও নেমে আসতে পারে রাজনীতি। থুড়ি অনলাইন গেমের প্লে-স্টেশনে। হ্যাঁ, শুধু ইভিএম নয়, কি-বোর্ডেও ভোট দিতে পারেন বইকি আপনি। ভোটের বাজারেই কিস্তিমাত নানারকম ভোট-গেমেরও।
আরও শুনুন:
‘গরিবি’ হটিয়ে ‘আচ্ছে দিন’ এল কি? দশে মিলে দেশের রাজনীতি চেনাল স্লোগানেরা
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের ভোট বলে কথা। বাজার সবকিছুকেই কাজে লাগায়, আর তাকে লাগাবে না! দেশের ভোট নিয়ে প্রথম সাড়া ফেলেছিল যে ভোট গেম, তাকে ঢালা হয়েছিল সাপলুডোর ছাঁচে। ভোট এবং ভোটার, দুই-ই এখানে গেমিং ব্যবসার ঘুঁটিই বটে। তবে সে তো আড়ালের কথা, প্রকাশ্যে নিজের নিজের দলের কিংবা জোটের নেতাই এখানে খেলার ঘুঁটি। এক এক ক্লিকে পুট বা ছক্কা যা পড়বে, সেই মাপেই এগোবে ঘুঁটিগুলো। একেবারে অনলাইনে লুডো খেলার মতোই। যদি দলের চিহ্নে, বা নিজস্ব পার্টি অফিসের আইকনে, বা ডোনেশনের থলিতে ঘুঁটি পড়ে, তাহলে মই। আর বিরোধী দলের চিহ্নে, বা কালো রঙের ডোনেশনে অর্থাৎ দুর্নীতির ব্ল্যাকমানি কিংবা নির্বাচন কমিশনের কোনও কড়া বিধিতে যদি ঘুঁটি ঠেকে যায়, তাহলেই জুটবে সাপের ছোবল। আরেক ভোটের খেলায় খেলোয়াড় নিজেই হয়ে গিয়েছিলেন এক ভোটভিখারি নেতা। ঝুড়ি হাতে তিনি ছুটে ছুটে বেড়ান স্ক্রিন জুড়ে, আর ওপর থেকে ভেসে ভেসে নামে ব্যালট পেপার, ফুলের মালা, ডাস্টবিন আর পচা ডিম। বলাই বাহুল্য, ব্যালটে আর মালায় মিলবে পয়েন্ট। আর সাপের মুখে পড়ার মতোই, ডাস্টবিন আর ডিমে খেলা ঘুরবে মাইনাসে।
আরও শুনুন:
আমজনতা নিয়ে নেতাদের মাথাব্যথা, আমআদমির মাথায় শুধুই আম
তবে কেবল ইন্ডোর গেমে কি আর সাধ মেটে? এ দেশের খেলার বাজারে সবচেয়ে বেশি ভোট নিঃসন্দেহে জোটে ক্রিকেটের ভাগ্যে। আমজনতার পালস বুঝেই সেই ক্রিকেটের আদলেও বানানো হয়েছে ভোট গেম। ঠুকে ঠুকে চলা টেস্ট ক্রিকেট নয়, একেবারে হাল আমলের আইপিএল-এর গা গরম করা ময়দানেই নামিয়ে দেওয়া হয়েছে মোদি, রাহুল, কেজরিওয়ালকে। অনলাইনের এই বাইশ গজের যুদ্ধে নিজের দল বানাবেন খেলোয়াড়, আর তার ক্যাপ্টেন হিসেবে বেছে নিতে পারেন এই তিনজনের যে কোনও একজনকে। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের মরশুমে ‘কুর্সি ক্রিকেট’ নামে এই খেলায় মেতে উঠেছিলেন হাজার হাজার নেটিজেন। যদিও ২০০৯ সালে সরাসরি আইপিএল নাম দিয়েই বাজারে এসেছিল এই খেলাটি। অর্থাৎ ‘ইন্ডিয়ান পলিটিকাল লিগ’। সেখানে অবশ্য ক্যাপ্টেন ছিলেন মনমোহন কিংবা আডবাণী, সঙ্গে গ্যালারিতে হাজির ছিলেন জোট শরিকরাও। আবার প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীকে জুতো ছোড়া নিয়েও চালু হয়েছিল ‘চপ্পল কি গুঞ্জ’ নামে একটি গেম। মঞ্চে বক্তৃতা করছেন এক নেতা, সামনে জনতার ভিড়। ভিড়ের মধ্যে আনাচকানাচ থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে জুতো হাতে এক-এক জন। ক্লিকের ঘায়ে তাকে নিরস্ত করতে পারলে নেতা বাঁচবেন, নইলে জুতো পৌঁছবে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে।
তবে ভোটের খেলা নিয়ে শুধু ব্যবসাই হয়নি। ভোটের কাজেই ভোট-গেমকে ব্যবহার করেছিল খোদ নির্বাচন কমিশনও। ২০১৪ সালে ‘গেট সেট ভোট’ নামে একটি গেমকে এ ব্যাপারে সিলমোহর দেওয়া হয়। হোম থেকে বেরিয়ে বুথ পর্যন্ত যাওয়ার পথটাই সেখানে গোলকধাঁধা। প্যাঁচালো রাস্তাগুলোর মোড়ে মোড়ে রাখা আছে এনার্জি বাড়ানোর খাবার, আবার বুথে যেতে বাধা দেওয়ার জন্য অদ্ভুত জীবরাও হাজির। আবার যাত্রাপথের মাঝে মাঝেই ভেসে উঠবে সংবিধান ও ভোট সংক্রান্ত নানা প্রশ্ন। এইসব ধাঁধা ও বাধা পেরিয়ে ইভিএম-এ পৌঁছে ভোট দিতে পারাই ছিল এই গেমের চ্যালেঞ্জ। জনতাকে ভোটমুখী করে তুলতেই এহেন চমক ব্যবহার করেছিল খোদ জাতীয় নির্বাচন কমিশন।
আরও শুনুন:
দেওয়াল জোড়া প্রচার আছে, তবে বদল লিখনেই
এমনিতে নির্বাচনকে বলা হয় গণতন্ত্রের সেরা উৎসব। গণতন্ত্র, যা আসলে প্রত্যেক মানুষের মতপ্রকাশের পক্ষে সওয়াল করে, সেই মতপ্রকাশেরই সর্বোচ্চ প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই ভোট ব্যবস্থা। তাই মনে করা হয়, সেই সমস্ত প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ আসলে জনতার হাতেই। সে নিজে মাঠে নেমে খেলতে যায় না বটে, কিন্তু খেলার রিমোট থাকে তারই হাতে। এই কারণেই সমাজের সবচেয়ে সাধারণ মানুষটিকেও গণতন্ত্রে সবচেয়ে শক্তিশালীর তকমা দিয়েছিলেন চার্চিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই আম মানুষেরা যে ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দারই মাত্র, তাও কি আর বলার অপেক্ষা রাখে! তার ভোটে কতটুকুই বা বদলায়! অনলাইনের ভোট-গেমে নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখার সন্তুষ্টি, নির্বাচনের সেই নিয়ন্ত্রণ হারানোকেই নাহয় চিনিয়ে দিয়ে যাক।