কোনও একজন নেতা বা এক দলের কথা নয়। নয় কেবল ভোটরঙ্গও। আদতে গোটা দেশের রাজনীতির বয়ান ধরা পড়তে থাকে স্লোগানের মিছিলে। সে রাজনৈতিক ইতিহাসের চলন কীভাবে বদলে বদলে যাচ্ছে , তার মানচিত্র লিখতে পারে স্লোগান।
স্লোগানে স্লোগানে ঢাকা দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা থাকে ভোটরঙ্গ। লেখা থাকে রাজনীতির ভাষ্যও। নানা সময়ের সেইসব স্লোগানকে পরপর সাজিয়ে নিলেই তাই তৈরি হতে পারে এক অদ্ভুত কোলাজ। যে কোলাজ আদতে শাসকদের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটা গোটা বইয়ের মতো। স্লোগান যেমন কোনও একটা এলাকার সামাজিক ইতিহাসের উপাদান, তেমনই সমগ্র দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের মানচিত্রও সাজিয়ে দেয় স্লোগানের মিছিল।
আরও শুনুন:
আমজনতা নিয়ে নেতাদের মাথাব্যথা, আমআদমির মাথায় শুধুই আম
ঠিক যেমন এই দশ স্লোগান। দশের রাজনীতি, দেশের রাজনীতির মোটামুটি ষাট বছরের চলনকে চিনিয়ে দিতে পারে এইসব ল্যান্ডমার্ক স্লোগানেরা। ১৯৬৫ সালে, দেশের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর গলায় শোনা গিয়েছিল, ‘জয় জওয়ান, জয় কিষান’। বোঝাই যাচ্ছে, ‘সিয়াচেন মে হামারা জওয়ান লড় রাহা হ্যায়’-এর বয়ান জনপ্রিয় হয়ে ওঠার বহু আগেই জওয়ান-দের জয়গাথার সুর বেঁধেছিলেন আরেক প্রধানমন্ত্রী। সেই স্লোগানে ভর করে দু’বছর পর নির্বাচনে ক্ষমতায় ফেরে কংগ্রেস।
৭১-এ সেই কংগ্রেস শিবির থেকেই উঠে এসেছিল ‘গরিবি হটাও’-এর স্লোগান। তখন একদিকে নকশাল আন্দোলনের অস্থিরতা, আরেকদিকে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের দরুন উদ্বাস্তুদের ভিড়, সব মিলিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে দেশ। সেই পরিস্থিতিতে ইন্দিরা গান্ধীর এই সপাট স্লোগান কংগ্রেসকে আকাশছোঁয়া জয় এনে দিয়েছিল।
কিন্তু এই দুই স্লোগানে মুখ্য ছিল দেশের ও দশের কথা, যা বদলে গেল পরের লোকসভা নির্বাচনে। ১৯৭৭-এ সোশালিস্ট নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের স্লোগানে দেশ বাঁচানোর অছিলায় বড় হয়ে দেখা দিল ব্যক্তি আক্রমণ। কিন্তু ‘ইন্দিরা হটাও দেশ বাঁচাও’ স্লোগানকে আপন করে নিয়েই সেবার গদি উলটে দিল জরুরি অবস্থা পেরিয়ে আসা দেশবাসী। জনতা দলের ছাতার নিচে সরকার গড়ল বিরোধীরা।
আরও শুনুন:
মাছ, মাংস, মিষ্টি… স্বাদের আহ্লাদও আসর মাতাচ্ছে ভোট-রাজনীতির
‘৮৪-র নির্বাচনী স্লোগানেও কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে জ্বলজ্বল করে উঠলেন সেই ব্যক্তি ইন্দিরাই। দেহরক্ষীর হাতে কংগ্রেস নেত্রীর আকস্মিক মৃত্যুর জেরে দেশজুড়ে গর্জে উঠল স্লোগান- “যব তক চান্দ সুরজ রহেগা, ইন্দিরা তেরা নাম রহেগা”। আর সেই স্লোগান সত্যি করেই সেবার ৪০০ আসন পেরোয় হাত শিবির।
১৯৮৯ সালের নির্বাচনেও দেশ আর ব্যক্তি মিলেমিশে গেল একরকম করে। সংবিধানে দেশ নিজেকে যতই গণতান্ত্রিক বলে ঘোষণা করুক, রাজনীতির মহলে ব্যক্তিপূজাকে যে এড়িয়ে চলা যাবে না, সে কথাই বোধহয় স্পষ্ট হয়ে উঠছিল এই চলনে। ইন্দিরা গান্ধীর প্রবল ব্যক্তিত্ব ভারতীয় রাজনীতিতে যে একক অস্তিত্বের সূচনা করে দিয়েছিল, তাকে সম্ভবত আর মুছে ফেলা সম্ভবও ছিল না। কেবল কংগ্রেসই নয়, বিরোধীদের উপরেও তার ছাপ পড়েছিল ভালোমতোই। তাই রাজীব গান্ধীর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে ভি পি সিং যখন জনতা দলের প্রার্থী হয়ে দাঁড়ালেন, তাঁর পক্ষে স্লোগান উঠল- ‘রাজা নহি ফকির হ্যায়, দেশ কি তকদির হ্যায়’। এলাহাবাদের মান্ডা প্রদেশের রাজাবাহাদুর ভি পি সিং-এর রাজকীয় পরিচয় সরিয়ে রেখেই সেবার বাজিমাত করেছিল তাঁর দল।
এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি জারি রেখেই ৯৬-তে বিজেপি স্লোগান তোলে, “বারি বারি সবকি বারি, আব কি বারি অটলবিহারী”। প্রথমে ১৩ দিনের শাসন, তারপর ফের দুই অসম্পূর্ণ টার্মে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলান বাজপেয়ী। ২০০৪ সালে শেষ টার্ম ফুরোতে সেবারও নির্বাচনে দাঁড়ান তিনি। এবার অবশ্য কোনও ব্যক্তির বদলে সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নতির ইস্তেহারই সামনে আনে বিজেপি। স্লোগান ওঠে, ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’। যদিও সে আশ্বাসে ভরসা রাখতে পারেনি ইন্ডিয়া, যার ফল দেখা যায় ব্যালটে। এনডিএ-কে হারিয়ে ক্ষমতা দখল করে কংগ্রেস। তাদের স্লোগান ছিল, “কংগ্রেস কা হাত, আম আদমি কা সাথ”। বর্তমানে ইন্ডিয়া জোটে হাত শিবির আর আম আদমি পার্টির সম্পর্ক যাই দাঁড়াক, ২০০৪ সালের নির্বাচনে ওই স্লোগানেই ভোট দিয়েছিল ইন্ডিয়া।
আরও শুনুন:
দেওয়াল জোড়া প্রচার আছে, তবে বদল লিখনেই
তবে ‘ইন্ডিয়া শাইনিং’-এর মন্ত্র ২০১৪-তে আরও জোরালো হয়ে ফিরল ‘আচ্ছে দিন’-এ। দেশ উন্নতি করছে এই দাবিকে মানুষ বিশ্বাস করতে পারুক বা না পারুক, দেশ উন্নতি করবে এই কথায় মানুষ ভরসা পেয়েছিল বইকি। নতুন দিনের স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় আসে বিজেপি-পরিচালিত এনডিএ। এই আমলে ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে পেগাস্যাস, একাধিক দুর্নীতির কথা সামনে এসেছে। উঠেছে বিরোধীদের কণ্ঠরোধের অভিযোগও। ফলে আচ্ছে দিন আদৌ এসেছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে দিন ফিরুক বা না ফিরুক, সরকারের ক্ষমতা দিনে দিনে এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে চব্বিশের চলতি নির্বাচনে ‘আব কি বার চারশো পার’-এর স্লোগান তুলেছে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি। সেই স্লোগান সত্যি হবে কি না শেষমেশ, তা বলবে ইভিএম। তবে ‘গরিবি’ হটানো যাক বা না যাক, ‘আচ্ছে দিন’-ও আসুন বা না আসুক, এইসব স্লোগানের পথ ধরে দেশের রাজনীতির এই দীর্ঘ পথচলাকে যে একরকমভাবে চিনে নেওয়া যায়, তা অস্বীকারের জো নেই।