‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’, দেবী অন্নপূর্ণার কাছে প্রার্থনা ছিল ঈশ্বরী পাটনীর। যা সহজে মেলে, এককালে পুষ্টি খুঁজে নেওয়ার তাগিদ ছিল সেখান থেকেই। কিন্তু নতুন ভারতে সেই চাওয়া কেমন যেন বদলে গেল। সন্তানকে পুষ্টিকর খাবার জোগানোর আর্তি রইল ঠিকই, কিন্তু সেই পুষ্টির জন্য দুধ ভাতের মতো হাতের নাগালে পাওয়া ঘরোয়া খাবারে আর ভরসা রইল না। পরিবর্তে যা কিছু অতিরিক্ত দামি, অতিরিক্ত চকচকে, সেইসব বিজ্ঞাপনী মায়াই হয়ে উঠল পুষ্টির আরেক নাম। একের পর এক শিশুখাদ্য, হেলথ ড্রিংক-এর উপর নিষেধাজ্ঞার আবহে প্রশ্ন উঠছে, সেই বদলে যাওয়া প্রার্থনায় লাভ হয়েছিল তো?
দেবী অন্নপূর্ণার দেখা পেয়ে ঈশ্বরী পাটনী ধনদৌলত চাননি, চাননি সাতমহলা প্রাসাদও। তাঁর কেবল এটুকুই প্রার্থনা ছিল, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’ বাংলার ঘরে এককালে চাওয়াটুকু এমনই হাতের নাগালে ছিল। জমির ধান, গরুর দুধ, পুকুরের মাছ কি পাড়ের শাকপাতা, যা সহজে মেলে, সেখান থেকেই ছিল পুষ্টি খুঁজে নেওয়ার তাগিদ। যদি বাংলার ভাষার একেবারে প্রাচীন যুগের নিদর্শনে চোখ রাখি, সেখানেও দেখা যাবে, কবি লিখছেন-
“ওগগরা ভত্তা, রম্ভাঅ পত্তা,
গাইক ঘিত্তা, দুগ্ধ সজুত্তা”।
বেশি কিছু নয়, কলাপাতায় গরম ভাতের উপর গরুর দুধে তৈরি ঘি, সঙ্গে দুধ। এমন পাতেই বাঙালির পেট আইঢাই। শুধু বাংলাতেই কি, ভারতবর্ষে নয়? যা ছিল ভারতে, তার ছবি মহাভারতে তো মিলবেই। আর সেখানেই ছেলে অশ্বত্থামাকে দুধ খাওয়াতে না পেরে দ্রোণের দুঃখ কি ভোলবার? সেদিন যদি অশ্বত্থামাকে দুধের বদলে পিটুলিগোলা খেতে না হত, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ অব্দিই হয়তো গড়াত না সমস্যা। কিন্তু নতুন ভারতে সেই চাওয়া কেমন যেন বদলে গেল। সন্তানকে পুষ্টিকর খাবার জোগানোর আর্তি রইল ঠিকই, কিন্তু সেই পুষ্টির জন্য দুধ ভাতের মতো হাতের নাগালে পাওয়া ঘরোয়া খাবারে আর ভরসা রইল না। পরিবর্তে যা কিছু অতিরিক্ত দামি, অতিরিক্ত চকচকে, সেইসব বিজ্ঞাপনী মায়াই হয়ে উঠল পুষ্টির আরেক নাম। বিজ্ঞাপন বুঝিয়ে দিল, যা হাতের নাগালে মেলে, তার আসলে দাম নেই কোনও। আর যার দাম নেই, তার গুণও নেই। এই নবলব্ধ জ্ঞানে বদলে গেল সন্তানকে দুধে ভাতে রাখার প্রার্থনা, বদলে সন্তানের মুখে সেরেল্যাক-বোর্নভিটা-হেলথ ড্রিংক তুলে ধরতে না পারলেই মরমে মরে যেতে লাগলেন আপামর মা-বাবারা।
আরও শুনুন:
বাঙালির হাল-খাতা: স্মৃতির ভাঁড়ার হাতড়েই পাত বাড়ে বাঙালি
প্রার্থনা বদলাল বটে। লাভ হল কি আদৌ? সম্প্রতি যেসব খবর সামনে এসেছে তাতে উলটো কথাই কিন্তু বলতে হয়। সবেমাত্র বোর্নভিটা-সহ একই ধরনের একাধিক পানীয়ের ‘হেলথ ড্রিংক’ তকমা কেড়েছে কেন্দ্র। আরও বড় কথা হল, এই সব পানীয় নিজেদের সঙ্গে ‘হেলথ ড্রিংক’-এর তকমা ঝুলিয়ে রাখলে কী হবে, ২০০৬-র খাদ্য সুরক্ষা বিধিতে হেলথ ড্রিংক বলে কোনও শ্রেণির উল্লেখই নেই। উপরন্তু ‘ন্যাশনাল কমিশন অফ প্রোটেকশন ফর চাইল্ড রাইটস’-এর তদন্ত জানাচ্ছে, এই সব পানীয়তেই রয়েছে অতিরিক্ত মাত্রায় চিনি, যা কোনও পরিস্থিতিতেই ‘হেলদি’ নয়। একই দোষে দুষ্ট সেরেল্যাকও। ওবেসিটি-সহ অন্যান্য রোগ প্রতিরোধের জন্য শিশুদের খাবার নিয়ে যে আন্তর্জাতিক নির্দেশিকা রয়েছে, প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে সেই নিয়ম মেনেই শিশুখাদ্য বানায় নেসলে। কিন্তু এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে যে সেরেল্যাক পাওয়া যায়, তাতেই মেশানো হয় বাড়তি চিনি। তৃতীয় বিশ্বটাই যেখানে পুঁজির এত বড় বাজার, সেখানে তৃতীয় বিশ্বের শিশুদের সুরক্ষাও তো আদতে বাজারের পণ্যই। ভারতে মোট ১৫ রকমের সেরেল্যাক পাওয়া যায়। পরীক্ষা করে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবার একটি শিশুকে যতটা পরিমাণ সেরেল্যাক দেওয়া হয়, তাতে তিন গ্রাম করে চিনি থাকে। ইথিওপিয়া এবং থাইল্যান্ডে ওই একই পরিমাণ সেরেল্যাকে থাকে ছ’গ্রাম চিনি। একইভাবে প্রচুর চিনি থাকে এনার্জি ড্রিংকেও। চটজলদি এনার্জি বাড়ানোর জন্য মাত্রাতিরিক্ত চিনি অর্থাৎ গ্লুকোজে ঠাসা হচ্ছে এইসব খাদ্য পানীয়। সন্তানকে দুধে-ভাতের বদলে সেরেল্যাক-বোর্নভিটায় রেখে তাহলে আদতে লাভ হল কি?
অবশ্য বিজ্ঞাপন বলেছে লাভের কথা। বলেছে, আরও লম্বা, আরও শক্তিশালী, আরও বুদ্ধিমান হতে চাইলে ওসব না খেয়ে কোনও উপায় নেই। হেলথ ড্রিংকের গায়ের ছবি বলেছে, ওসব পানীয় খেলেই তালপাতার সেপাই-রাও মুহূর্তে গামা পালোয়ান হয়ে যায়। এমনকি ১৯৭৭ সালে নেসলে-কে ঘিরে যে বিতর্ক শুরু হয়েছিল, তাতে শোনা যায় যে নিজেদের তৈরি ফর্মুলা দুধ বিক্রির জন্য স্তন্যপানের বিরুদ্ধে মতামত দিচ্ছে সংস্থাটি। মাতৃস্তন্যের তুলনায় কোনও কৃত্রিম দুধ বেশি উপকারী, এ কথা শুনলে যে কোনও চিকিৎসকই আকাশ থেকে পড়বেন। কিন্তু তাতে কী! বিজ্ঞাপনে যা দেখা যায় তাই সত্য, এই বিশ্বাসে ভুলেছে মানুষও। শুধু উচ্চ বা মধ্যবিত্তের ঘরে নয়, নিম্নবিত্তের ঘরে আরও দ্রুত ঢুকে পড়েছে এইসব ফুড সাপ্লিমেন্ট। এমনকি যারা তা কিনতে পারেননি, তারাই যেন একরকম পিছিয়ে থাকা শ্রেণি হয়ে পড়েছেন ‘স্ট্রঙ্গার’ আর ‘শার্পার’ পরিবারের ভিড়ে।
আরও শুনুন:
মাছ, মাংস, মিষ্টি… স্বাদের আহ্লাদও আসর মাতাচ্ছে ভোট-রাজনীতির
খাবারের প্রসঙ্গে এক লেখা এমনই এক নিম্নবিত্ত খুকির কথা বলেছিল। পেটের দায়ে শহরে পরিচারিকার কাজ করতে এসেছিল সে। এখানেই তার টিবি ধরা পড়ে। গৃহকর্ত্রী উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন, সঙ্গে মশলাহীন ভাত মাছের উপযুক্ত পথ্য। কিন্তু খুকির মায়ের মন ভরে না, কেননা ‘হল্লিক’ না খেলে মেয়ে সারবে কেমন করে! তাই তাকে চলে যেতে হয় অন্য বাড়ির কাজে, বন্ধ হয়ে যায় যাবতীয় চিকিৎসা। সে খুকি বাঁচে না। কিন্তু হেলথ ড্রিংক না খেয়ে নয়, তার গ্রামে-ঘরের নাগালে থাকা সাধারণ কমদামি শাক-মাছ না খেতে পেয়েই।
এরপর কি আর আমাদের স্বাস্থ্যকর খাবার নিয়ে সত্যিই কিছু বলার থাকে?