ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহ্যে গেরুয়া ত্যাগের রং, সন্ন্যাসের রং। অথচ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যেন সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে সে রং। যে রঙে আশ্রয়ের ঠিকানা লেখা ছিল, ধর্ম নিয়ে অসহিষ্ণু আচরণের নিরিখে তা-ই তুলে দিচ্ছে বিভাজনের কাঁটাতার। আমরাও গেরুয়া রংকেই যেন সেই বিভাজনের সঙ্গে, অসহিষ্ণুতার সঙ্গে সমার্থক করে দেখছি। ভুলে যাচ্ছি যে, আসলে ওই অর্থ জুড়ে দিয়েছে মানুষই।
লাল থেকে গেরুয়া। নির্বাচনী আবহে পালটে গেল দেশের সরকারি গণমাধ্যমের লোগো। আর সেখানেই ঘটল এমন রংবদল। কেন্দ্রীয় তথ্যসম্প্রচার সংস্থা প্রসার ভারতী, ডিডি ইন্ডিয়ার পর ডিডি নিউজের প্রতীককেও সাজাল গেরুয়া রঙে। যা দেখে অনেকেই মনে করছেন, এও আদতে বিজেপির গেরুয়াকরণেরই প্রস্তাবনা। সংস্থার প্রাক্তন সিইও জহর সরকার তো সরাসরিই তোপ দেগে বলেছেন, প্রসার ভারতী আসলে প্রচার ভারতীতে পরিণত হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রচার বলতে এখানে সরকারের সপক্ষে প্রচার করার কথাই বোঝানো হচ্ছে।
আরও শুনুন:
দেওয়াল জোড়া প্রচার আছে, তবে বদল লিখনেই
এ কথাও বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোনও গণমাধ্যম সম্পর্কে এমন ধারণা তৈরি হলে তা দুর্ভাগ্যজনক। দেশের পক্ষেও, দশের পক্ষেও। কারণ গণের কাছে গণের খবর পৌঁছে দেওয়ার কাজটিই গণমাধ্যমের করার কথা। যে কোনও খবর, যে কারও খবর। দলমতের রঙে কোনও খবরকে ডুবিয়ে নেওয়া, কিংবা রং দেখেই কোনও খবরকে বাতিল করা সে আদর্শের পরিপন্থী। গণমাধ্যম, বিশেষ করে সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। শাসকের মসনদে যে দলই থাকুক না কেন, গণমাধ্যমের দায়িত্ব নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। আবার উলটো দিকে গণমাধ্যমের সেই নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিকেই রক্ষা করার কথা শাসকেরও, সে শাসকের পক্ষে কথা বলুক বা না বলুক। অথচ, এ কথাও অস্বীকারের জো নেই যে, এই আদর্শ বাস্তবে রক্ষিত হয় না অধিকাংশ সময়েই। বরং ভাবনার খোরাক জোগায় এমন কোনও ব্যক্তি, সংস্থা, বস্তু, সবকিছুর উপরেই শাসক একচেটিয়া অধিকার কায়েম করতে চায়। যাতে সেই ভাবনাকে শাসকের নিজের ছাঁদে গড়েপিটে নেওয়া যায়। তেমনটা হলে শাসকের বিরুদ্ধে গলা তোলার সম্ভাবনাও ক্রমে কমে আসে।
এখানেই ভেবে দেখা দরকার, যে, তেমন গড়েপিটে নেওয়া যে কোনও সময়েই ঘটতে পারে। রং বদলে, কিংবা না বদলেও। কিন্তু সেই গড়েপিটে নেওয়াকেই একমাত্র সত্যি মনে করে কোনও রঙের সঙ্গে তার সমীকরণ টানলে, অন্য সত্যিগুলির থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা হয়। আসলে তো রঙের গায়ে যেটুকু নামপরিচয় লেগে থাকে, তার সঙ্গে নিজের মতো অর্থ জুড়েই কালার প্যালেট বানায় মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে সেইসব অর্থের উদ্দেশ্য ছিল একটাই, রাঙিয়ে তোলা। বর্তমানে সময় জটিল হয়েছে, জট বেড়েছে মানুষের মনের ভাবনাতেও, আর সেই জটিলতারই ছাপ পড়েছে রঙের অর্থে। সেখানে একটা বড় ভূমিকা যে রাজনীতির, তা অস্বীকার করা চলে না। ভারতবর্ষের প্রাচীন ঐতিহ্যে গেরুয়া রঙের এক সমাহিত গম্ভীর তাৎপর্য ছিল। তা ত্যাগের রং, সন্ন্যাসের রং। অথচ এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যেন সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে সে রং। যে রঙে আশ্রয়ের ঠিকানা লেখা ছিল, ধর্ম নিয়ে অসহিষ্ণু আচরণের নিরিখে তা-ই তুলে দিচ্ছে বিভাজনের কাঁটাতার। আমরাও গেরুয়া রংকেই যেন সেই বিভাজনের সঙ্গে, অসহিষ্ণুতার সঙ্গে সমার্থক করে দেখছি। ভুলে যাচ্ছি যে, আসলে ওই অর্থ জুড়ে দিয়েছে মানুষই।
আরও শুনুন:
সেইজন্যই এ কথা মনে রাখা দরকার, যে, গেরুয়া রং মানে কেবল একটি দল মাত্র নয়। একটি রংকে কেবল একটি অর্থের হাতে, সেই সূত্রে একটি দলের হাতে সব অধিকার ত্যাগ করে ছেড়ে দেওয়া হবে কেন! এই যেমন, পদ্ম সৌন্দর্য কিংবা নির্মলতার ইঙ্গিত দেয়, পুজোর ক্ষেত্রেও তা জরুরি উপচার। কেবল কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দল তাকে প্রতীক করেছে বলেই কি পদ্মের অপরাপর তাৎপর্যগুলি ভুলে যাওয়া সাজে! তাহলে কিন্তু আদতে তাদেরই জিতিয়ে দেওয়া হবে, যাঁরা ওই বিভাজন বা সংকীর্ণতার পক্ষে সওয়াল করছেন। কোনও ফুল, বা কোনও ধর্মের উপরেও যেমন কোনও একটিমাত্র দলের একার অধিকার বর্তায় না, সেই একই কথা খাটে রঙের ক্ষেত্রেও। কোনও রংকে কেবল রাজনৈতিক নিশান বলে ভাবলে ভুল হবে, আবার সে রং ছাড়া রাজনৈতিক নিশান না চিনতে পারলে আরও বড় ভুল হয়ে যাবে। রং না বদলেও যে গেরুয়াকরণ সম্ভব, এবং দেশজুড়ে নানাভাবেই তা সম্ভব হয়ে চলেছে, সেই পালটে দেওয়ার প্রবণতাই চোখ এড়িয়ে যাবে তখন। সেই ভুলের ফাঁদে যদি পা না-ই দিতে হয়, তাহলে কোনও রং-কে কারও কায়েমি সম্পত্তি না ভাবাই মঙ্গলের। রঙের জন্য তো বটেই, আমাদের জন্যও।