দ্য গ্রেট ডিক্টেটর-এর চ্যাপলিন যেন জাল কেটে বেরিয়ে আসা রক্তকরবীর রাজা। মরা যৌবনের অভিশাপ গায়ে মেখে বহুদিন কেটেছে তার। অবশেষে যখন সে মুক্তির সন্ধান পেল, লড়াই তখন তার নিজের বিরুদ্ধে তারই। নন্দিনী যখন জানতে চাইল ‘কোথায় যাব?’, রাজা বলেছিল, ‘আমার বিরুদ্ধে লড়াই করতে, কিন্তু আমারই হাতে হাত রেখে।’চ্যাপলিনের ডিক্টেটর যেন এই মুক্তিকামী রাজা, যে নিজের ‘নেটওয়ার্ক’ ভেঙে বেরিয়ে আসছে। বেশভূষা ডিক্টেটরের মতোই। তবে তিনি বলছেন শাসকের ঠিক বিপরীত কথা। বলছেন, মানুষের কথা, মানবিকতার কথা, গণতন্ত্রের পরিসরে মানুষের সম্মিলিত অমিত শক্তির কথা।
ইতিহাসের আশ্চর্য রসিকতাই বলতে হবে! চ্যাপলিন আর হিটলারের জন্মের ব্যবধান ছিল মোটে দিন চারেকের। দুই বিপরীত মেরু যেভাবে একই সঙ্গে পৃথিবীতে থাকে। হিটলারের চিন্তা-ভাবনা এবং পৃথিবী নির্মাণের যে আদর্শ, তা যে কোন ভয়াবহতার দিকে মানুষের সভ্যতাকে এগিয়ে দিতে পারে, ইতিহাস তার সাক্ষী থেকেছে। মুশকিল হল, ইতিহাস নিজেই নিজেকে পুনরাবৃত্ত করে। প্রথমে, প্রহসন হিসাবে, দ্বিতীয়বার বিপর্যয় হয়ে নেমে আসে। এ কথা মানুষ জানে। জেনেও ভুল করে। ফলে, বহুযুগের ওপারে যে বীভৎসতার লীলা চলেছিল, তা ফিরিয়ে আনতেও কসুর করে না। দেখা যায়, সভ্যতা জুড়ে আবার সেই একই অসুখ। উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারণায় শুদ্ধিকরণ, সংকীর্ণতার শতেক বেড়া এসে মানুষকে আত্মচ্যুত করছে। পৃথিবী তখন নীলকণ্ঠ। খানিক অসহায়ও। তার সেই নিসঙ্গতায় তখন এসে দাঁড়ান চ্যাপলিন। চার্লি চ্যাপলিন। বিষিয়ে ওঠা সভ্যতায় মানবিকতার অক্লান্ত ফেরিওয়ালা।
দ্য গ্রেট ডিক্টেটর-এর চ্যাপলিন যেন জাল কেটে বেরিয়ে আসা রক্তকরবীর রাজা। মরা যৌবনের অভিশাপ গায়ে মেখে বহুদিন কেটেছে তার। অবশেষে যখন সে মুক্তির সন্ধান পেল, লড়াই তখন তার নিজের বিরুদ্ধে তারই। নন্দিনী যখন জানতে চাইল ‘কোথায় যাব?’, রাজা বলেছিল, ‘আমার বিরুদ্ধে লড়াই করতে, কিন্তু আমারই হাতে হাত রেখে। বুঝতে পারছ না? সেই লড়াই শুরু হয়েছে। এই আমার ধ্বজা, আমি ভেঙে ফেলি ওর দণ্ড, তুমি ছিঁড়ে ফেলো ওর কেতন। আমারই হাতের মধ্যে তোমার হাত এসে আমাকে মারুক, মারুক, সম্পূর্ণ মারুক— তাতেই আমার মুক্তি।’ ফাগুলালের বন্দিশালা ভাঙার দলে শামিল হয় রাজা নিজেও, বলে, ‘ভাঙার পথে আমিও চলেছি। ঐ তার প্রথম চিহ্ন— আমার ভাঙা ধ্বজা, আমার শেষ কীর্তি।’ এই ভাঙা অব্দি শেষ পর্যন্ত পৌঁছতেই হয় রাজাকে। ইতিহাসের সেটাই বোধহয় নিয়তি। রক্তকরবীর ইংরেজিতে ‘নেটওয়ার্ক’ শব্দটি রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই মানুষখেকো ‘নেটওয়ার্ক’-এর পতন হয় রাজারই কল্যাণে। যে ‘মগজধোলাই’ একদিন সাধারণ মানুষের উপর প্রযুক্ত হয়েছিল, সেই মগজধোলাই একদিন বরাদ্দ হয় খোদ রাজার জন্য। রাজা তখন নিজেই নিজের মূর্তি খানখান করতে যায়, দড়ি ধরে টান মারার আহ্বান জানায়। শাসকের এই মনবদলের কথা ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর ‘রক্তকরবী’তে, বঙ্গাব্দের হিসাবে যে নাটক এবার শতবর্ষ পূর্ণ করছে। চ্যাপলিনের ডিক্টেটর যেন এই মুক্তিকামী রাজা, যে নিজের নেটওয়ার্ক ভেঙে বেরিয়ে আসছে। তার বেশভূষা ডিক্টেটরের মতোই। তবে তিনি বলছেন প্রবল প্রতাপাণ্বিত শাসকের ঠিক বিপরীত কথা। বলছেন, মানুষের কথা, মানবিকতার কথা, গণতন্ত্রের পরিসরে মানুষের সম্মিলিত অমিত শক্তির কথা।
এই ছবিতেই চ্যাপলিন প্রথম তাঁর চিত্রভাবনায় সংলাপের প্রয়োগ ঘটালেন। প্রযুক্তি-ক্ষমতা-স্বৈরতন্ত্রের যে সম্মিলিত জাল, তার ভিতর পড়ে মানুষ যে ক্রমে রাজার এঁটো হয়ে উঠছে তা বহুবার বহু ছবিতেই বলেছেন তিনি। যন্ত্রের থেকে মানুষকে, যান্ত্রিকতার থেকে মানুষের অনুভবকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা তাঁর ছবির অনুচ্চারিত সংলাপ ছিল। এবার বললেন সোচ্চারে, তাও ডিক্টেটরের মুখ দিয়ে। গবেষকরা বলে থাকেন, ছবির শেষের এই বক্তব্য রচনার জন্য খুব পরিশ্রম করেছিলেন চ্যাপলিন। একাধিকবার কাটা-ছেঁড়ার পর তবে এই অংশটুকু পছন্দ হয়েছিল তাঁর। সেই ১৯৪০-এ মিনিট তিনেকের সেই বক্তব্যে, তিনি যা বলেছিলেন তা আদতে মানুষের মুক্তির চিরকালীন সংলাপ। এই মানুষের কথা তুলে ধরার জন্য চ্যাপলিনের জীবন পর্যন্ত বিপর্যস্ত হয়েছে। তিনি কমিউনিস্ট কি-না, এ নিয়ে ঘোর সন্দেহ এবং সেইহেতু চলেছে তদন্ত; ঘরও ছাড়তে হয়েছে তাঁকে। তবে, চ্যাপলিন জানতেন বিপ্লবী হওয়া তাঁর লক্ষ্য নয়। বিপ্লব কেবল বিপ্লবীরাই করতে পারেন। তাহলে তিনি কী পারেন? বলতেনও যে, তিনি পারেন আরও কয়েকটি ছবি বানাতে। সেটিই তাঁর একমাত্র কাম্য। তবে, যেভাবে একটি ধারণা বিপ্লবের জন্ম দিতে পারে, চ্যাপলিন নিজে যাই-ই বলুন না কেন, তিনি আদতে তাই-ই। আর তাই ডিক্টেটরের মুখে মানবিকতার সংলাপ সংযোজন করে তিনি যা করেছিলেন, তা বৈপ্লবিকই বটে। যেরকম রাজার জাল কেটে বেরিয়ে আসা বৈপ্লবিক।
সেই মিনিট কয়েকের বক্তব্য প্রায় সারা বিশ্বের মানুষেরই কণ্ঠস্থ। যেখানে ডিক্টেটরের বেশে চ্যাপলিন বলছিলেন,- সকলকে ভালো রেখে তবেই আমাদের বেঁচে থাকা। অন্যের দুর্দশা আমাদের বাঁচার জ্বালানি হতে পারে না। একে অপরকে ঘৃণা-বিদ্বেষ আমরা করতে চাই না। বসুন্ধরা সকলেরই বাসযোগ্য। আমাদের জীবনও মুক্ত ও চমৎকার হয়ে উঠতে পারে, তবে, সেই পথটাই আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ঘৃণা আমাদের আত্মাকে বিষিয়ে তুলেছে; বিদ্বেষের বেড়ায় ভাগ হয়ে গিয়েছে পৃথিবী; ফলত কেবলই বিপর্যয় আর রক্তপাত। আমাদের কাছে গতি আছে, তবু আমরা নিজেদের স্থবির করে ফেলেছি। যন্ত্র আমাদের প্রাচুর্য দিয়েছে তবু ধনী করে তুলতে পারেনি। জ্ঞান আমাদের স্বার্থান্ধ করেছে, আমাদের চালাকি আমাদেরই করে তুলেছে নির্দয়। প্রযুক্তির থেকেও আমাদের তাই প্রয়োজন মানবিকতা। আমরা ভাবছি অনেক, অনুভব করছি না একফোঁটাও। চাতুর্য, বুদ্ধিমত্তার থেকেও আমাদের কাছে জরুরি দ্রবণীয় মন। এটুকু না থাকলে জীবন হিংসার হাতে বিলিয়ে যাবে, আমরা হারিয়ে ফেলব নিজেদের।
এ তো আসলে পৃথিবীরই মনের কথা। মহাপরাক্রমশালী স্বৈরশাসক তাই যখন নিজের সৈন্যদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করতে বলেন, তা দৃশ্যত অবিশ্বাস্য, প্রকৃতপ্রস্তাবে গণ্মুক্তির স্বপ্ন বিলিয়ে দেয়। চ্যাপলিন তাই কমিউনিস্ট কি কমিউনিস্ট নন, তা শেষ পর্যন্ত বিবেচ্য থাকে না। এমনকী চ্যাপলিন নিজেও বলেছিলেন, নাৎসি বিরোধিতার জন্য কাউকে কোনও দল বা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ভুক্ত হতে হবে তার কোনও মানে নেই। তিনি একজন সাধারণ মানুষ হলেই হবে। আজ যখন সহমর্মিতার রাজনৈতিক চর্চা উবে যেতে বসেছে, দলীয় সংবিধান যখন মানুষ হিসাবে আমাদের ক্রমাগত খাটো করে দিচ্ছে, তখন এই অ্যালিয়েনেশনের পাশেও এসে দাঁড়ান চ্যাপলিন। সোচ্চারে বলেন, সবার উপর মানুষ সত্য। এসো, ঐক্যবদ্ধ হই, মানুষের জন্য। যে মানুষ নিজেই নিজের ইতিহাস রচনা করে। তবে, সে ইতিহাসে তার ভূমিকা নির্দিষ্ট থাকে না। চ্যাপলিন যেন শাসকের বয়ান মানুষের অভিমুখে ঘুরিয়ে দিয়ে সেই ভূমিকাটুকুই নির্দিষ্ট করে দিতে চান। তবু দুর্দশা আসে। ইতিহাসের মার এসে মানুষকে কাঁদায়। সেই অশ্রুনদীর সুদূর পারে যতদূর আলো যায় ততদূর জেগে থাকে মানবিকতা। আর সেখানেই আশ্চর্য অন্তর্ঘাত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন চার্লি চ্যাপলিন।