হুতোমের কথা ধরে বলা যায়, পয়লা বৈশাখের মান আজও ধরে রেখেছে হালখাতা ও বইপাড়া। বইপাড়ায় হালখাতার পুরনো এক দস্তুর আছে। নতুন ক্যালেন্ডার, ডাব শরবত, সন্দেশের সঙ্গে কী মসৃণভাবেই মিলেমিশে যেতে থাকে সাহিত্য। প্রকাশনের দপ্তরে লেখক-পাঠক আড্ডায় সহিতত্বের কথাই যেন মনে পড়ে নতুন করে। সবাইকে একসুতোয় বেঁধে দেয় রোদ চনমনে বৈশাখ। বাঙালির সাহিত্যের হাল-খাতায় সেই আমেজের দস্তখত রাখলেন বিশ্বদীপ দে।
অলংকরণ: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
পয়লা বৈশাখ মানে অবধারিতভাবেই বুকের ভিতরে রোদজলের একটা আয়নার ঝিকিয়ে ওঠা। হুতোম লিখেছিলেন, ‘ইংরেজরা নিউ ইয়ারের বড় আদর করেন। বাঙ্গালীরা বছরটা ভালোভাবেই যাক আর খারাপেই শেষ হোক, সজনেখাড়া চিবিয়ে, ঢাকের বাদ্যি আর রাস্তার ধুলো দিয়ে, পুরনোকে বিদায় দেন। কেবল কলসী উচ্ছুগগু কর্তারা আর নতুন খাতাওয়ালারাই নতুন বৎসরের মান রাখেন।’ হুতোম নেই, ঢাকের বাদ্যি, সজনেখাড়ার নিপাট বাঙালিয়ানাতেও হরেকরকম কুয়াশা জমেছে। পয়লা বৈশাখ তবু আসে। নিঃসন্দেহে ইংরেজি বছরের শুরুটা অনেক জমকালো। সারা পৃথিবীতেই তা পালিত হতে থাকে। বাংলা বছর হয়তো তার মতো করে আসে আর চলে যায়। বাংলায় এটা কোন সাল, জিজ্ঞাসা করলে কদিন পর অনেকেই মনে করতে পারবেন না। তবু পয়লা বৈশাখ পুরনো প্রেম, হারানো দিনকালের মতো রয়ে গিয়েছে বুকের পাঁজরের গভীরে। বড় আপন হারানো কোনও বন্ধুর মতো। তাছাড়া পয়লার একটা আলাদা কদর থাকেই। বৈশাখের এই দিনে তাই বুকের ভিতরে বুজকুড়ি কাটতে থাকা ইচ্ছেরা নতুন করে বাতাস ভরে নেয় ফুসফুসে।
তবে হুতোমের অনুষঙ্গ টেনে বলা যায়, পয়লা বৈশাখের মান আজও আসলে ধরে রেখেছে হালখাতা ও বইপাড়া। এশিয়ার বৃহত্তম ও সবচেয়ে প্রাচীন বইপাড়া আমাদের কলেজ স্ট্রিট। বইপাড়ায় হালখাতার পুরনো এক দস্তুর আছে। নববর্ষ শুরুর দিন চার-পাঁচ আগে থেকেই দোকানে দোকানে শুরু হয়ে যায় ঝাড়পোঁছ। চাঁদমালা, ফুলে সেজে উঠতে থাকে চারপাশ। তার পর আসে নতুন বছর। আর নতুন ক্যালেন্ডার, প্যারামাউন্টের ডাব শরবত, পুঁটিরামের সন্দেশের সঙ্গে কী মসৃণভাবেই মিলেমিশে যেতে থাকে সাহিত্য। বৈশাখের খররৌদ্র, পথের ধুলোর ধূসরতা সব কিছুকেই নস্যাৎ করে নতুন ঝকঝকে পাজামা পাঞ্জাবিতে হাজির হয়ে যান অতিথিরা। বিভিন্ন প্রকাশন দপ্তরে লেখক-প্রকাশকদের জমজমাট আড্ডা। বহু প্রকাশকই এদিন রয়্যালটির চেক তুলে দেন লেখকদের হাতে। এদিকে নতুন বছরে নতুন বই হাতে তুলে নিতে সাহিত্যিকদের সেই ভিড়ে বহু সময়ই মিশে যান পাঠকরাও। রোদ চনমনে বৈশাখ সবাইকে একসুতোয় বেঁধে দেয় নতুন করে।
এক দশকেই কেমন আমূল বদলে গিয়েছে আমাদের চারপাশ। চেনা জগৎটাই যেন ক্রমে অচেনা হয়ে উঠছে। কিন্তু নববর্ষে কলেজ স্ট্রিটের এই ছবিটা আজও অমলিন। বইমেলার আগে বছরের এই দিনেই প্রকাশিত হত সব নতুন বই। সেই সুগন্ধ ও আড্ডার হইহই আজও রয়েছে। এদিন বইপাড়ার গৌরবময় পথে ঘাটে স্মৃতিকাতর মানুষরা কান পাতেন, ভাসিয়ে দেন দৃষ্টি। দেখতে পান কবিশেখর কালিদাস রায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণদের। ওই বুঝি বিভূতিভূষণ সিগারেট ধরিয়ে চেঁচিয়ে উঠছেন, ”দেখেছ ফোতো বাবুদের কাণ্ড। পাখাটা বন্ধ কর না। তাড়াতাড়ি পুড়ে যাবে তো!” তাঁর সেই রসিকতায় আশপাশে সকলে হেসে উঠছেন। কিংবা সূর্য সেন স্ট্রিট দিয়ে হাঁটছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর উদাস ও অপসৃয়মাণ চেহারা এবার বাঁক নিল কোনও প্রকাশনার গলির দিকে। নজরে পড়ে ফেলে আসা কোন এক কালখণ্ড জেগে আছে বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে। এমন ভিড় যে শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটে পায়ে হেঁটেও ঢোকা যাচ্ছে না। লাঠি হাতে অসহায় পুলিশ। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের’ অখণ্ড সংস্করণ কিনতে মানুষের ঢল নেমেছিল সেই প্রাচীন এক নববর্ষের সকালে। রোদের তেজ, ভিড়ের দাপটেও মানুষ দাঁড়িয়ে ঠায়। সেই ভিড়ে কলেজপড়ুয়া থেকে অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ, যুবাপুরুষ কে নেই!
এইসব হারানো মানুষদের ভিড়ে কিংবদন্তি সাহিত্যিক ও মনোযোগী পাঠকদের সঙ্গে মিশে থাকেন যশোপ্রার্থী লেখক-কবিরা। তাঁদের আমরা মনে রাখিনি। কিন্তু কলেজ স্ট্রিটের পয়লা বৈশাখে তাঁরাও বুঝি মিশে রয়েছেন চিরকালীন জলছাপ হয়ে। সেইসব তথাকথিত অখ্যাত মানুষদের না পূরণ হওয়া স্বপ্নের গন্ধ কি আমরা পাই না আজকের নতুন বইয়ের পুস্তানি কিংবা বাঁধাইয়ের আঠার ভিতরে! ওঁদের ছাড়া বইপাড়া অসম্পূর্ণ।
এসব নিয়েই কলেজ স্ট্রিট। নতুন বছরের প্রথম দিন লেখক-প্রকাশক-পাঠকদের এমন অপূর্ব সম্মিলন পৃথিবীর আর কোনও দেশে আছে কি না সন্দেহ। হয়তো ই-বুকের বাড়তে থাকা জনপ্রিয়তার ভিড়ে বইয়ের গন্ধ ক্রমেই ‘বিপন্ন প্রজাতি’ হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবু এই নতুন দিনকালে দিব্যি মিশে রয়েছে বাঙালির সেকাল। কলেজ স্ট্রিট আর পয়লা বৈশাখের যুগলবন্দি সেকথাই মনে করিয়ে দিয়ে যায় বারবার। আর বুঝিয়ে দেয়, কিছুই হারায় না আসলে। থেকে যায়। কেবল খুঁজে পাওয়ার অপেক্ষা।
(ছবি সূত্র: শুভঙ্কর দে)
:আরও শুনুন:
বাঙালির হাল-খাতা : ময়দানি তাঁবুতেও ফিরুক বাংলা
বাঙালির হাল-খাতা : বছরের সঙ্গে সঙ্গে কি বদলে গেল প্রেমের মনও?
বাঙালির হাল-খাতা : বঙ্গনেতাদের কথায় ফিরুক সৌজন্য
বাঙালির হাল-খাতা : হালখাতার সঙ্গে বাঙালির বছর শুরুর পুজোপাঠ
বাঙালির হাল-খাতা: স্মৃতির ভাঁড়ার হাতড়েই পাত বাড়ে বাঙালি