একটাই নির্বাচনী কেন্দ্র। তার জন্য লড়েছিলেন ১০৩৩ জন প্রার্থী। চিহ্নের হিসাব রাখতে ৬৫ পাতার বই ছাপাতে হয়েছিল নির্বাচন কমিশনকে। এদিকে, ভোট দিতে গিয়ে নাজেহাল হয়েছিলেন সাধারণ ভোটাররাও। কী এমন হয়েছিল, যার জন্য স্রেফ একটা নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে এতজন প্রার্থী ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
শিয়রে নির্বাচন। দেশজুড়ে জোর কদমে প্রচার শুরু করেছে প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলই। নির্বাচন কমিশনেরও দম ফেলার সময় নেই। কিন্তু আসন্ন নির্বাচনে যতই ব্যস্ততা থাক, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের সঙ্গে তার কোনও তুলনাই চলে না। কারণ সে বছর দক্ষিণের এক কেন্দ্রের জন্য ভোটের ময়াদানে নেমেছিলেন ১০৩৩ জন প্রার্থী।
আরও শুনুন: ইভিএম নয়, ফিরুক ব্যালট! এই দাবিতেই যোগীরাজ্য থেকে ভোটে লড়ছেন আইনজীবী
শুনত অবাক লাগলেও সত্যি। নির্বাচনের ইতিহাসে এই ঘটনা এখনও চর্চায় রয়ে গিয়েছে। স্রেফ প্রার্থী বেশি হওয়া নয়, এই নির্বাচনে কমিশনকেও এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা এখনও বদলায়নি। এছাড়া সেবারের নির্বাচনের বহরও ছিল দেখার মতো। গোটা দেশে সাধারণ ভাবে ভোট মিটলেও, সকলের আলোচনার কেন্দ্রে ছিল তামিল নাড়ুর ইদোর জেলার মোদাকুরিচি কেন্দ্রটি। এখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দাই কৃষিজীবি। তাই এই ঘটনার সঙ্গে কৃষকদের ভালমতো যোগ রয়েছে। বলা ভালো কৃষকরাই এমন অদ্ভুত কাণ্ড ঘটিয়ে সরকারের নজরে আসতে চেয়েছিলেন। এমনিতে কোনও একটা কেন্দ্র থেকে ৪-৫ জন প্রার্থী লড়াইয়ে নামেন। তাঁদের দল আলাদা। দলের প্রতীকীও আলাদা। এছাড়া নির্দল হিসেবে এলাকার কোনও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব ভোটে দাঁড়াতেই পারেন। অনেকসময় নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করে এই নির্দল প্রার্থীদের উপরই। তবে সেই সংখ্যাও খুব বেশি ২-৩ জন। এদিকে তামিল নাড়ুর ওই নির্বাচনী কেন্দ্রে সেবার নির্দল হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন ১০২৯ জন প্রার্থী। তাঁদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিলেন যারা একটাও ভোট পাননি। কেউ কেউ মাত্র ১ টা ভোট পেয়েছিলেন। কেউ বা সামান্য বেশি। অর্থাৎ নির্বাচনের ফলাফলে যে বিরাট কিছু পরিবর্তন হয়েছিল তা নয়, কিন্তু এই ব্যাপক হারে প্রার্থী দেখে চমকে উঠেছিল গোট দেশ। সবথেকে বেশি সমস্যায় পড়েছিলেন নির্বাচন কমিশনের কর্তারা। কেউই ভাবতে পারেননি এত সংখ্যায় প্রার্থী মনোনয়ন জমা দেবেন। নিয়ম অনুযায়ী অনেককে বাতিলও করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রার্থীর সংখ্যা হাজার ছাপিয়ে যায় অনায়াসে। বাধ্য হয়ে ভোটের দিনক্ষণ একমাস পিছিয়ে দেয় কমিশন। আলাদা ভাবে ছাপানো হয় ‘ব্যালট বই’। এও নির্বাচনের ইতিহাসে প্রথম। কারণ সাধারণ নির্বাচনে কয়েকটা মাত্র দলের লড়াই, সেখানে এক পাতার মধ্যে প্রার্থীদের দল বা প্রতীকীর ছবি রাখা যায়। কিন্তু এখানে প্রার্থী সংখ্যা ১০৩৩। তাই আলাদাভাবে প্রত্যেকের চিহ্নের হিসাব রাখতে ৬৫ পাতার বই ছাপিয়ে ছিল কমিশন। স্বাভাবিক ভাবে ব্যালট বাক্সের আকারও ছিল রীতিমতো বড়। আর ভোট দিতে দিতে কখন যে দিন কাবার হয়েছিল, সেসব বুঝতেই পারেননি কেউ।
আরও শুনুন: ভোটের বাজার হাজারও দুর্নীতির অভিযোগে সরগরম, আদৌ কি তাতে প্রভাবিত হন ভোটাররা?
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এমনটা কেন করেছিলেন সেখানকার মানুষজন?
সবটাই সরকারের নজর কাড়তে। এলাকার কৃষকরা দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে সরব হয়েছিলেন। কিন্তু সেসব কোনও আমল দেয়নি তৎকালীন সরকার। লাভ হয়নি বিরোধী পক্ষকে বলে বা আন্দোলন করে। তাই বুদ্ধি খাটিয়ে কৃষকরা ঠিক করেন তাঁরা নিজেরাই লড়বেন নির্বাচন। সেখান হার-জিত যাই হোক, তাঁরা আলোচনায় থাকবেন এটাই ছিল উদ্দেশ্য। বাস্তবে হয়েওছিল তাই। এও এক ধরনের আন্দোলনই বটে, কিন্তু এক্ষেত্রে নজর না দিয়ে থাকতে পারেনি সরকারও। পাশাপাশি এই ভোট থেকে শিক্ষা নিয়ে দুটি বিশেষ সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। চালু করা হয় ‘নোটা’-য় ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা। এবং প্রার্থীদের ভোটে দাঁড়ানোর জন্য যে টাকা জমা করতে হত সেই পরিমানও এক ধাক্কায় অনেকটা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ওই নির্বাচনের আগে মাত্র ২৫০ টাকা দিলেই নির্বাচনে লড়ার সুযোগ মিলত, সেটা বাড়িয়ে করা হয় ১০ হাজার। যদিও সেসব নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না সেখানকার কৃষকদের। তাঁদের দাবি পূরণ করাই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য। শোনা যায় আংশিক ভাবে তা হয়েওছিল। কিন্তু নির্বাচনী লড়াইয়ের মাধ্যমে যে এভাবে আন্দোলন গড়া যায় তা এখনও উদাহরণ হিসেবে রয়ে গিয়েছে।