ভোটের সময় যেভাবে মুহুর্মুহু দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তাতে ঠক বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাওয়ার জোগাড়। তাহলে এই এত অভিযোগের ভিতর মানুষ কাকে ভোট দেবেন তা ঠিক করেন কী করে? নাকি দুর্নীতির এই যাবতীয় অভিযোগ ভোটারকে আদৌ প্রভাবিতই করে না? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
ভোটের বাজারে কে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত? তা বলার জন্য কোনও পুরস্কার হয় না। তবে, ভোট এলেই দুর্নীতির অভিযোগের একেবারে রমরমা। অমুক দল বলে, তমুক দলের নেতারা সব দুর্নীতিতে ডুবে আছেন। তো পালটা দিয়ে সেই দলের নেতারা বলেন, ওঁদের মুখে আবার দুর্নীতির কথা মানায় নাকি! এই তরজা চলতেই থাকে। সাক্ষী থাকেন ভোটাররা। প্রশ্ন হল, এত যে দুর্নীতির অভিযোগ, তাতে কি আদৌ বদলায় ভোটারের মন?
আরও শুনুন:
প্রথমবার আঙুলে কালি, ভোটের খেলা ঘুরিয়ে দিতে ওস্তাদ নতুন ভোটাররাও
একেবারে বদলায় যে না, তা বললে ভুল হয়। বহুক্ষেত্রেই ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করতে গিয়ে, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন যে, দলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ কোনও একটি দলের পরাজয়ের অন্যতম কারণ। রাজনীতিকরাও সর্বদা চেষ্টা করেন স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বজায় রাখতে। ফলত দুর্নীতি যে ভোটরঙ্গের অন্যতম কুশীলব তা অনস্বীকার্য। তবে, দুর্নীতির অভিযোগ আর ভোটারের ভোট দেওয়ার প্রবণতা- এই দুয়ের সম্পর্কটা মোটেও সহজ নয়। অর্থাৎ মস্ত একটা দুর্নীতির অভিযোগ উঠল বলেই যে রাতারাতি ভোটারের মন ঘুরে যাবে, এমনটা এক কথায় বলা যায় না। কেননা ভোটার যে বিচার-বিবেচনায় নির্দিষ্ট কাউকে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তা বেশ জটিল একটি প্রক্রিয়া। সেখানে দুর্নীতির অভিযোগের ভূমিকা নিশ্চয়ই থাকে, তবে তা একমাত্র নির্ণায়ক নয়।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে যে, দুর্নীতির অভিযোগ সেভাবে ভোটারকে বিচলিত করেই না। এর একটা মূল কারণ হতে পারে যে, এই সংক্রান্ত তথ্যই ভোটারের কাছে সেভাবে পৌঁছয় না। অথবা যদিও বা পৌঁছয়, সেই দুর্নীতির মাত্রা বা তা কী সংকট ডেকে আনতে পারে তা সম্পর্কে জনতা সেভাবে অবহিত থাকেন না। সমীক্ষা তাই বলছে, বহুক্ষেত্রেই দেখা যায় দুর্নীতি বা অপরাধের অভিযোগ আছে এমন নেতাকে ভোট দিতে ভোটাররা পিছপা তো হনই না, বরং খুশিই হন। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ২০১৪-এর ভোট নিয়ে একটি পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। মনে করা হয়ে থাকে, দুর্নীতির অভিযোগেই কংগ্রেস সরকারের পতন হয়েছিল। তবে, গবেষকরা বলছেন, তথ্য দিয়ে এই ধারণা প্রমাণিত হয় না।
তাহলে দুর্নীতি কি ভোটারদের প্রভাবিত করেই না? বিশেষজ্ঞদের মতে, করে, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ছোট মাত্রার দুর্নীতি। অর্থাৎ বৃহত্তর স্ক্যামের যে অভিযোগ ওঠে, তা নিয়ে তাঁরা ততটাও ভাবিত হন না, যতটা চিন্তিত হয়ে পড়েন স্থানিক দুর্নীতি নিয়ে। যে দুর্নীতির প্রত্যক্ষ্য প্রভাব পড়ে তাঁদের জীবনে। বা, যে দুর্নীতির দরুন তাঁদের প্রাত্যহিক জীবনযাপন ব্যাহত হয়, তাই-ই সবার আগে তাঁদের চোখে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা ধরে নেন যে, যে সব বড়বড় দুর্নীতির কথা বলা হচ্ছে তাতে তাঁদের জীবনের বিরাট কিছু প্রভাব পড়বে না। হয়তো পড়েও না। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, নির্বাচনী বন্ডে কোন দল কোন মাত্রায় লাভবান হয়েছে, তা নিয়ে যে চাপানউতোর চলছে, সেই বিষয়টিকে হয়তো সাধারণ একজন ভোটার সেভাবে গুরুত্ব দেবেন না। তুলনায় বরং, স্থানীয় কোনও দুর্নীতি, যা সেভাবে বড় খবর হয়ে উঠছে না, তার নিরিখেই ভোটদানের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন একজন ভোটার।
আরও শুনুন:
রাজনীতির উপরে থাকুক আইন-সংবিধান, দেশ বাঁচাতেই মনে করাচ্ছেন প্রধান বিচারপতি?
উপরন্তু, কোন নির্দিষ্ট দলের যে নেতার নামে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে, তিনি কিছুদিন পরেই দল বদলে ফেলতে পারেন। তখন আচমকা দুর্নীতির অভিযোগের অভিমুখটাই ঘুরে যায়। ভোটাররা এই অবস্থার সাক্ষী থাকেন বলেই, দুর্নীতির অভিযোগকে গুরুত্ব দেওয়ার আগে দুবার ভাবেন। পাশপাশি ভোটারদের অন্যান্য চাহিদা তো থাকেই। সরকারে আসার ক্ষেত্রে বা থাকার ক্ষেত্রে একটা দলের প্রশাসনিক দক্ষতা কতখানি, জনমুখী প্রকল্পের সুবিধা কতটা পাওয়া যাচ্ছে এগুলো তাঁদের কাছে বিবেচ্য হয়ে ওঠে। দুর্নীতির নৈতিক অভিযোগের থেকেও সেগুলোর গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। ফলে, একটা দল আর একটা দলকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলতেই পারে। তবে সেই তথ্য বা অভিযোগই যে একেবারে ভোটদানের সম্ভাবনা বদলে দিতে পারে, তা নয়।
অর্থাৎ দুর্নীতির প্রেক্ষিতে ভোট দেওয়া আর না-দেওয়ার মনস্তত্ব একটু জটিলই। তাহলে ভোটের বাজার দুর্নীতি নিয়ে এত সরগরম হয়ে ওঠে কেন? কারণ দুর্নীতি যে নৈতিকভাবে একটা খারাপ জিনিস, জনমানসে সে ধারণা থাকে। তাই সেই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ শানানো অনেক সহজসাধ্য। যে কোনও দলের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ অনেকগুলো কারণে একযোগে জমাট বাঁধতে থাকে। ভোটের ফলাফলে যার প্রমাণ মেলে। দুর্নীতির অভিযোগ সেখানে একটি কারণ হতে পারে, যদি তা সরাসরি ভোটারের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে, নচেৎ নয়। আর তাই দুর্নীতির অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কোন দল নির্বাচন বৈতরণী পার হয়ে যেতে পারে। ভোটকেন্দ্রিক গণতন্ত্রের ব্যবস্থায় এ-এক রহস্যই বটে।