বহু বিখ্যাত মানুষও এই ছবি তুলে ধরেই সম্প্রীতির বার্তা দেন। সেই সঙ্গে মনে করিয়ে দেন, রাজনৈতিক কারণে যেভাবে দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কে চিড় ধরছে, তা কাম্য নয়। অন্তত সেই চেষ্টা যদি কেউ বা কারা করে থাকেন, তাহলে তা রুখে দেওয়াই উচিত।
কেউ বলেন সম্প্রীতি, তো কেউ দেশের ঐতিহ্য। দূর আকাশে একফালি চাঁদের আভাস। আর ইশারায় তা দেখাচ্ছেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। পিছনে দাঁড়িয়ে তাঁর ভক্তরা। আরও স্পষ্ট করে বললে মুসলিম ভক্তরা। নিঃসন্দেহে সে ছবি চমৎকার। তবে সাম্প্রতিক অতীতে আরও একটি কারণে সেটি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। অনেকেই মনে করেন, মুসলিম ভক্ত ও কৃষ্ণ যে একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন, তা ভারতবর্ষের সম্প্রীতির ঐতিহ্যেরই পরিচয় বহন করছে। ইদের সময় এই ছবি সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকী বহু বিখ্যাত মানুষও এই ছবি তুলে ধরেই সম্প্রীতির বার্তা দেন। সেই সঙ্গে মনে করিয়ে দেন, রাজনৈতিক কারণে যেভাবে দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কে চিড় ধরছে, তা কাম্য নয়। অন্তত সেই চেষ্টা যদি কেউ বা কারা করে থাকেন, তাহলে তা রুখে দেওয়াই উচিত।
রাজনীতি যেভাবে সামাজিক বন্ধনকে বিদ্বেষের ছুরিতে কাটতে চায়, বাস্তব সবসময় সেরকমটা নয়। ইতিহাস যেমন বিপর্যয়ের, তেমনই সহাবস্থানেরও। সম্প্রদায়গত ভেদ মেনে নিয়েও একই দেশে বহু মানুষ যে একে অন্যের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে নিজেরা মিলেমিশে থাকেন, থাকতে পারেন, সেটিই দেশের শক্তি। ভারতবর্ষের সাধনার যে ঐতিহ্য, তাও এই মানবতার কথাই বলে। তবে, কখনও সময় আসে, জীবন মুচকি হাসে। তখন এই বিদ্বেষের প্রসার যেন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া হয়ে ওঠে। আর তার বিপরীতে দাঁড়ানোর জন্যই মানুষ সম্প্রীতির উদাহরণগুলো খুঁজে খুঁজে আনেন। ঠিক সেই কারণেই এই পুরনো ছবিটি নতুন করে গুরুত্ব পেয়েছে।
আরও শুনুন: নাম পালটে রব্বন খাঁ করার কথা ভেবেছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর! কিন্তু কেন?
ছবিটি ঠিক কোন সময়ের তা নিয়ে মতভেদ আছে। মনে করা হয়, সতেরো বা আঠেরো শতকের এই ছবি। ঘরানা রাজস্থান মিনিয়েচার পেন্টিং-এর। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে যদি এই ছবি কল্পনা করা হয়ে থাকে, তবে তাঁর গুরুত্ব অনেকটাই বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, ছবিটি মুসলিম শিল্পী রুকনুদ্দিনের আঁকা। সেই সময় বিকানেরের রাজা মোগল দরবার থেকে শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানাতেন। সেভাবেই রাজস্থানে এসেছিলেন শিল্পী আলী রেজা, যাঁর শিষ্য রুকনুদ্দিন। ফলত তাঁর চিত্রকলায় মোগল ঘরানার ছাপ থাকত। যেহেতু এই ছবিটিও দুই সম্প্রদায়ের মেলবন্ধনকেই চিহ্নিত করছে, তাই মনে করা হয় যে, ছবিটি শিল্পী রুকনুদ্দিনেরই আঁকা।
আরও শুনুন: বিদ্যাসাগর মহাশয় যদি ভোটে দাঁড়াতেন, কী থাকত তাঁর নির্বাচনী ইস্তাহারে?
তবে এখানে গোল বাধল অন্য জায়গায়। শিল্পী রুকনুদ্দিনের ছবিতে রাজস্থানী ও মোগল ঘরানার ছাপ ছিল সত্যি; তবে, তাঁর অন্যান্য চিত্রকলার সঙ্গে এই ছবিটি কোনও ভাবেই সাযুজ্যপূর্ণ নয়। অর্থাৎ একজন শিল্পীর অলংকরণের যে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে, তার সঙ্গে এই ছবিটির মিল হচ্ছে না। ছবিটির ঐতিহাসিকতা সন্ধানে বিশেষজ্ঞরা শিল্পীর সব কাজ খুঁটিয়ে দেখেই এরকম সিদ্ধান্তে পৌঁছন। অর্থাৎ ছবিটি কার আঁকা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। এর পরের প্রশ্ন উঠে আসে ছবিটির ঘরানা নিয়েও। যেভাবে এটি মিনিয়েচার ঘরানার ছবি বলে প্রচারিত হয়ে থাকে, তার সঙ্গে সহমত নন অনেকেই। বিশেষত চিত্রকলা নিয়ে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের মতে, এই ছবিটির সঙ্গে বরং মিল পাওয়া যাচ্ছে পাহাড়ি ঘরানার চিত্রকলার। হিমালয়ের পার্বত্য এলাকা থেকে যে শিল্পের বিস্তার। দুই ঘরানার যেমন কিছু মিল আছে, তেমন প্রভেদও যথেষ্ট। ফলত, সাধারণ ভাবে দুই ধরনের ছবিকে মিলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থেকেই যায়। এই ছবির ক্ষেত্রেও তাই-ই হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। পাহাড়ি ঘরানার ছবিতে কৃষ্ণের প্রসঙ্গ দেখা যায়। গিরি গোবর্ধন ধারণের পৌরাণিক গল্প-সহ একাধিক অনুষঙ্গ এই ঘরানায় চিত্রকলায় উঠে এসেছে। এবং সেখানে চরিত্রদের দাঁড়ানোর যে ভঙ্গি, যেরকম অভিব্যক্তি তাঁদের চোখেমুখে দেখা যায়, তার সঙ্গে আলোচ্য ছবিটির মিল অনেকখানিই। এই বিচারের নিরিখেই ছবিটিকে পাহাড়ি ঘরানার বলেই মনে করেন চিত্রকলা বিশেষজ্ঞদের কেউ।
আরও শুনুন: মিথ্যে হোক, তবু যে সব ছবি অন্য পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়
তাহলে প্রশ্নটা গিয়ে দাঁড়াল এই জায়গায় যে, সত্যিই কি এই ছবিতে মুসলিম ভক্তদের চাঁদের আভাস দেখাচ্ছেন কৃষ্ণ? এখন, ভাগবত পুরাণ অনুযায়ী এরকম কোনও পৌরাণিক সূত্র পাওয়া তো অসম্ভব ব্যাপার। শিল্পীর কল্পনায় তা ফুটে উঠতেই পারে। তবে সেখানেও একটা খটকা দেখা যায়। কৃষ্ণের পিছনে দাঁড়ানো চরিত্রদের বেশভূষা যেরকম, তা মূলত হিন্দুদেরই। একই ধরনের অন্য ছবিতে রাজা নন্দকে কল্পনা করা হয়েছে ঠিক এরকম বেশেই। তাঁর মুখমণ্ডল শ্মশ্রুমণ্ডিত, পরনের পোশাক শরীরের বাঁদিকে টেনে এনে বাঁধা। পাহাড়ি ঘরানার অন্যান্য ছবিতে এই চরিত্র ছিল রাজা নন্দের। এই ছবিতেও তাঁকে সেভাবেই দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ, মুসলিম ভক্তদের চাঁদ দেখাচ্ছেন না শ্রীকৃষ্ণ। বরং তিনি রাজা নন্দ ও অন্যান্যদের চাঁদ দেখাচ্ছেন। সম্ভবত বরুণদেব কর্তৃক নন্দহরণের যে কাহিনি, তারই ছাপ আছে এই চিত্রকলায়। তবে কোনও সিদ্ধান্তই স্থির-নিশ্চিত কিছু নয়।
অর্থাৎ ছবিটির ঐতিহাসিকতা এবং ঘরানা নিয়ে মতভেদ আছে। বহুল প্রচারে তা বহুজনের কাছে সম্প্রীতির বার্তা হিসাবেই উঠে এসেছে। হয়তো চুলচেরা বিশ্লেষণে তা সত্যি বলে দাবি করা যায় না। তবে, যে সময়ে একটি ছবিকে আশ্রয় করেই সম্প্রীতির কথা জোর দিয়ে বলতে হচ্ছে, সেই সময়টাকে নিয়ে চিন্তা তো আছেই। পুরনো কোনও ছবি হয়তো সে চিন্তা ঘোচাতে পারে না। সে দায়িত্ব সমসময়ের সব সম্প্রদায়ের মানুষেরই।