কত বসন্তদিন পেরিয়ে গেল, তবু সুচিত্রাকে ছুঁতে পারল না ঝরাপাতারা। ‘টাচ করবে না’-র শাসনতর্জনীর সামনে অসহায় চেয়ে রইল সময়। আর সেই নয়নমোহিনীর দিকে অপলক চেয়ে রইল তিন-চার প্রজন্মের বাঙালি পুরুষ, যাদের সকলের গোপন প্রেমিকার নাম সুচিত্রা সেন। বাঙালির সেই শেষ না হওয়া পথের পদাবলি লিখলেন সরোজ দরবার।
সুচিত্রা সেন যদি না থাকতেন সমীরের ছোটকাকা নাকি সন্ন্যিসি হয়ে যেত। সে নাকি এমনিই একটু উড়নচণ্ডী প্রকৃতির। ঘর-সংসারে তেমন মন বসত না। নেশার মধ্যে দুই- ফুটবল আর উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা দেখা। সমীরের ঠাকুমার অষ্টম গর্ভের সন্তান ছিল এই ছোটকাকা। মা-মরা ছেলে। বিধবা পিসি একটু বেশি আদর দিয়েই তাকে মানুষ করেছিল। আর সেই আদরে নাকি মাথা একেবারে ঘুরে গিয়েছিল ছোটকাকার।
তবে পিসিমাকে ভয়ও করত খুব। তিনি ভয় পাওয়ার মতোই বটে। সমীরের জ্যেঠু-বাবা নাকি বলতেন, পিসিমার ডাকে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। তবে, সংসারটা সামলে রেখেছিলেন। শুধু সামলাতে পারলেন না এই ছোটকাকাকেই। বাড়ির অন্য ছেলেরা যখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে বা পড়ার চেষ্টা করছে, তখন একেবারে শাসনের হাত ছাড়িয়ে বাউন্ডুলে হয়ে গেল এই ছোট ছেলেটা। কোথা থেকে একটা বেহালা জোগাড় করে দিনরাত ছড় টানত। পাড়ার লোকে বলত, বাজনার হাত মন্দ নয়। তবে তাতে কি আর চিঁড়ে ভেজে! পিসিমা বাঘিনীর মতো গর্জন করে বলতেন, পুরুষমানুষ বাড়ি বসে বসে বেয়লা বাজাবে, এ আবার কী অনাসৃষ্টি কাণ্ড! সেই হুংকার শুনে ঘরে থাকবে এমন বুকের পাটা ছোটকাকার ছিল না। সে বেরিয়ে যেত বাড়ি থেকে। আর জনে জনে ডেকে বলত, আর নয় অনেক হয়েছে! এবার একটা ঝোলা সম্বল করে গেরুয়া ধারণ করে চিরকালের জন্য দেশত্যাগী হব!
পাড়ার লোকেরা এসে শান্ত করত। সন্ন্যাসী হওয়া এমন মন্দ কিছু ব্যাপার নয়। তবে, স্বামী বিবেকানন্দ তো অনেক শাস্ত্র ইত্যাদি পড়েছিলেন। সমীরের ছোটকাকার যে সে বিদ্যেটি নেই, তা মনে করিয়ে দেওয়া হত। ছোটকাকা খানিক মাথা চুলকে নিরুৎসাহ হয়ে পড়ত। তারপর বলত, একেবারেই শাস্ত্র না জানলে সম্ভব নয়? সকলে সমবেত ভাবে না বলতে মাথা নাড়াত। তারপর একটু উসকে দিয়ে বলত, ওসব চিন্তা ছাড়ান দাও দখি। তুমি বরং বেহালায় একটা উত্তম-সুচিত্রার গান বাজাও। ব্যস, এক কথাতেই ম্যাজিক। সমীরের ছোটকাকা একেবারে জলে পড়া গুড়ের বাতাসার মতোই গলে যেত। তারপর বেহালাখানা কাঁধে ফেলে শুরু করত- আমি স্বপ্নে তোমায় দেখেছি…।
সমবয়েসি দু-চারজন এই সুযোগে আর একটু পিছনে লাগতে ছাড়ত না। বলত, বাজিয়েছ তো খুবই ভালো। এবার পাড়ার ফাংশনে তোমার একটা একক অনুষ্ঠান রাখতেই হবে। তবে, ওই ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলো দিকি। সুচিত্রা সেনের সকল গান যে তোমাকে লক্ষ্য করেই, সে বিষয়টা একটু খোলসা করো। তখন যেন লকগেটের মুখ খুলে যেত। সমীরের ছোটকাকা বলত, নয়তো কী! ফোলানো চুলের ঝরনায় হাত বোলাতে বোলাতে সুচিত্রা যে বললেন, মন বলে ভালোবেসেছি, আঁখি বলিতে পারিনি লজ্জায়… সে কাকে? আয়নাকে? আর যদি তাই-ই হয়, ছোটকাকা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখেছে, নিজেকেই তো দেখা যায়। অতএব সুচিত্রা যে তাঁর উদ্দেশেই ঐশ্বরিক ভঙ্গিতে দুটি চোখে ঢেউ তুলে ‘লজ্জায়’ শব্দটি অননুকরণীয় উচ্চারণ করেছিলেন, এ নিয়ে তার কোনও দ্বিধা নেই। সমবয়েসিদের ইয়ার্কি এবার ছুটে গিয়ে পাকড়ে ধরত মোক্ষম প্রসঙ্গ, বলত, তাহলে নিশীথ বাসরশয্যায় সুচিত্রা সেন তোমাকেই দেখেছেন? সমীরের ছোটকাকা নাকি কেটে কেটে বলত, আলবাত! আমি সুচিত্রা সেনের প্রেমিক। এই শুনে সকলেই এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে গরমকে দোষ দিত। দিনকাল এমন তেতে উঠলে কি আর মাথার ঠিক থাকে ইত্যাদি! তবে একবার একজন এর পরেও তেড়ে উঠে বলেছিল, তাহলে সুচিত্রা যখন বলেন, ও যেন আমায় টাচ্ না করে, সেটাও তাহলে তোমাকেই? এই শুনে সমীরের কাকা নাকি হনহনিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছিল। দুদিন ভালো করে চান-খাওয়া করেনি। তারপর একদিন সেই ছেলের কাছে গিয়ে বলে এসেছিল, শোন, সুচিত্রা সেনকে টাচ্ করা যায় না।
সেবার বৈশাখী জলসায় সমীরের ছোটকাকা নাকি এমন বেহালা বাজিয়েছিল যে লোকে বহুদিন তা মনে রেখেছিল। এমনকী কেউ কেউ বলেছিল যে, সত্যি সত্যি সুচিত্রা সেনের প্রেমিক না হলে কেউ অমন করে তারের বুক থেকে সুর ছিঁড়ে বের করে আনতে পারে নাকি! ছেলেটার সঙ্গে সুচিত্রা সেনের একবার দেখা করিয়ে দেওয়া উচিত, এমনটাও ভেবেছিলেন কেউ কেউ। তবে, পর্দার বাইরে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে দেখা করার একেবারেই ইচ্ছে ছিল না ছোটকাকার। ফলে কেউ আর জোর করেনি। সুচিত্রা সেনের ঠিকানাও যে কেউ জানত না এমনটা নয়। তবে সমীরের ছোটকাকা সাত পাড়ায় একটা ঘটনা হয়ে উঠেছিল। তার নামধাম লোকে ভুলেই গেল ক্রমে। কেউ তার খোঁজ করলে লোকে চিনিয়ে দিতে বলত, ও ওই যে সুচিত্রা-পাগল! মেয়েরা তা শুনে হাসাহাসি করত। এমন পাগল প্রেমিকের দেখা মেলা ভার! তবে তার মন পড়ে আছে অন্ধকার সিনেমাঘরের অমরাবতীতে। মাটির পৃথিবীর ধুলো সে প্রেমের গায়ে লাগে না।
তবে হাটে হাঁড়িটা ভাঙল একদিন। সমীরের ছোটকাকা নাকি সত্যিই একজন মহিলার প্রেমে পড়েছিল। অনেক সাধ্যিসাধনাও করেছিল। তবে গোল বেধে গেল অন্য জায়গায়। সে মেয়ের কিছুতেই একজন বাউন্ডুলে বেহালাবাদককে মনে ধরে না। একদিন দেখা গেল, আবার দেশত্যাগী সন্ন্যিসি হবে বলে হনহনিয়ে হাঁটা দিয়েছে ছোটকাকা। এবারে অবশ্য পিসিমার তর্জন-গর্জন ছিল না। তিনি নাকি অল্প কেঁদে বাড়ির সকলকে ডেকে ডেকে বলছিলেন, ওরে ছেলেটাকে আটকা! আসল ঘটনাটা রটনায় রটনায় যা ছড়িয়েছিল তা মোটামুটি এইরকম যে, সেই প্রেমিকার কাছে গিয়ে বহুবার অনুরাগের কথা জানিয়েছিল ছোটকাকা। যতবার দেখা হয় সে মেয়ে শুধু চলে যেতে হয়। ছোটকাকা অনুনয় করে বলেছিল, কিছুক্ষণ নাহয় রহিতে কাছে! কিন্তু কোথায় কী! সুরে সুরভিতে বেলাও ভরে না। আর বাতাস প্রেমিকার এলোচুল নিয়ে খেলাও করে না। ব্যাকুল বকুলকুঁড়ির দেখা-টেখাও নেই। তবু বিরস দিন বিরল কাজের মুহূর্তে ছোটকাকা আকুল হয়ে বলেছিল, কিছু নিয়ে দিয়ে ওগো মোর মনোময়, সুন্দরতর হত না কি বলো, একটু ছোঁয়ার পরিচয়! বলে প্রেমিকার কোমল করতল দুটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়েছিল। তাতে মেয়েটি এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলেছিল, মরণ! ছোটকাকা তখন রাগ করে চলে যাওয়ার উপক্রম করছে। ভেবেছিল এবার সেই চাওয়া-পাওয়ার লাস্ট সিনটা হবে। দৌড়ে এসে কেউ একজন বলবে, যদি যেতে না দিই? ছোটকা বলবে, জোর? আর উত্তরে সেই মদালস আঁখি মেলে প্রেমিকাটি যেন সংক্ষিপ্ততম প্রেমের কবিতার মতোই বলে উঠবে, হুঁ জোর। ব্যস, চাওয়া-পাওয়া সম্পূর্ণ। তবে সেসব কিছুই হল না। মহিলা সমীরের ছোটকাকাকে এক লহমার জন্যেও দাঁড়াতে বলেনি। অতএব চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। আর যেতে যদি হয়, তাহলে একেবারে ঘর-সংসার ছেড়ে চলে যাওয়াই ভালো। তাই সে দেশত্যাগ করছিল। অনেক খোঁজখবর করে পরে জানা গিয়েছিল সে মেয়ের নামও ছিল, সুচিত্রা।
সে যাত্রা সমীরের ছোটকাকাকে নাকি আটকানো গিয়েছিল একটি উপায়েই। কে যেন তাকে চলে যেতে দেখে জোর গলায় বলেছিল, ওহে! সন্ন্যাসী হলে আর সিনেমা দেখতে পাবে না। সেই শুনে সে থমকে গেল। তারপর সাপুড়ের ঝাঁপিতে সাপের গুটিয়ে যাওয়ার মতো সুড়সুড় করে ফিরে এসেছিল ঘরে। সুচিত্রা সেনের প্রেমিক সমীরের সেই ছোটকাকাকে আমরা দেখিনি। সমীরের মুখে এ গল্প শুনেছি মাত্র। সমীরের সব গল্পে বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই, কেননা স্বভাবে সে ঘনাদা। তবে, সুচিত্রা-পাগল বাঙালি যুবকের কথা না বিশ্বাস করারও তেমন কোনও কারণ নেই।
তারপর কত দিন কেটে গেছে। কত বসন্ত পেরিয়ে গিয়েছে সিনেমাহলের অন্ধকার ঘরে। তবু সুচিত্রা সেন থেকে গেলেন। তিনি বয়স্কা হলেন না। গোটা তিন-চার প্রজন্মের প্রেমিকা হয়ে তিনি বাঙালি পুরুষকে বেঁধে রাখলেন এক পদাবলিতে। সমীরের ছোটকাকা বলত বটে, সুচিত্রা সেনকে কেউ টাচ্ করতে পারে না। সময় স্বয়ং সে কাজে নিদারুণ অসহায়। করুণ প্রেমিকের মতো সে-ও শুধু নয়নমোহিনীর সামনে নতজানু হতেই জানে।
আজকালকার বাঙালি অবশ্য অতি উত্তম আছে। তবে সুচিত্রার অতিও নেই, ইতিও নেই। তিনি অন্তহীন সুচিত্রা সেন। তাই বোধহয় মেট্রোর পথে মহানায়ককে মেলে, সুচিত্রা সেনকে নয়। পাওয়ার কথাও বোধহয় নয়- এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।