এই সময়টা ভাইরাল ফিভারেরই। মিথ্যে ছড়ানোর তাড়া ক্রমশ ছেয়ে ফেলেছে আমাদের সোশালের দুনিয়া। তার মধ্যেও মাঝে মাঝে এমন কিছু মিথ্যে উঁকি দিয়ে যায়, যার গায়ে ‘এমন কেন সত্যি হয় না’-র ‘আহা’টুকু বোলানো চলে। সে মিথ্যে আসলে কি আমাদের বোকা বানায়, নাকি আমাদের বোকামিগুলোকেই চিনিয়ে দিয়ে যায়?
ফেক ছবি? ক্ষতি নেই, যদি ভাবনা হয় খাঁটি। যদি সে ভাবনা একলার নীড় পেরিয়ে পৌঁছে যেতে পারে আরও বড় কোনও আকাশে, যদি বলে ফেলতে পারে বেঁধে বেঁধে থাকার কথা, তবে বলুক না। রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা, সেখানে এমন ছবি নাহয় মিথ্যে হয়েই সত্যি হোক। আসলে তো আমরা ছবিতেই বাঁচি। টুকরো টুকরো মুহূর্তের কোলাজ জুড়ে নিয়েই বোনা হয় আমাদের গোটা জীবন। তার কোনোটা আনন্দের, কোনোটা বা দুঃখের। কোনও ছবি বেঁচে থাকার গায়ে খানিক কালো রঙের প্রলেপ দিয়ে ফেলে, তো কোনও ছবি আবার বেঁচে থাকাটাকেই ছুপিয়ে নেয় বাড়তি রঙে। যেসব ছবিতে অমন বাড়তি রং থাকে অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার মতো, তা যদি বানিয়ে তোলাও হয়, তবু কি তাতে একটুকুও সত্যি লেগে থাকবে না?
আরও শুনুন:
যে শহরে শিশু নেই, সেখানে বড়দিন আসে না
সেই প্রশ্নই বুঝি উসকে দিল সাম্প্রতিক কালের এই ভাইরাল হয়ে যাওয়া ছবিটি। যেখানে দেখা গিয়েছে, নির্জন পাহাড়কে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে শান্ত হয়ে বসে আছে এক কিশোরী। আর তার গা ঘেঁষে, প্রায় গায়ে হেলান দিয়েই যেন বসে আছে এক তুষার চিতা। গল্পের মতো এই সহাবস্থান দেখে যে বিস্ময় চমকে উঠেছিল সকলের মনে, তার দরুনই মুহূর্তে নেটদুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এই ছবিটি। যদিও পরে জানা যায়, ছবিটি আসল নয়। এআই ব্যবহার করেই এই ছবিটি বানিয়েছেন বাবরাক খান নামে এক পাকিস্তানি শিল্পী। শুধু এই একটি ছবিই নয়, বস্তুত গিলগিট বালতিস্তান অঞ্চলের শিশুদের সঙ্গে সেই অঞ্চলের বন্যপ্রাণীদের বন্ধুত্ব নিয়ে এমনই এক সিরিজ বানিয়েছেন তিনি।
না, সেই ছবিগুচ্ছ সত্যি নয়। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব যদি সত্যি হত, খারাপ হত কি? এ প্রসঙ্গেই মনে আসছে এমনই আরেক বন্ধুত্বের ছবি। সেও অবশ্য বানানো গল্পই বটে। সে ছবিতে দেখা গিয়েছিল, এক হাতি শুঁড়ে করে বয়ে নিয়ে চলেছে এক সিংহশাবককে। পাশে পাশেই হাঁটছে সিংহী মা-ও। ক্রুগার ন্যাশনাল পার্কের তরফে প্রকাশিত এই ছবি জানিয়েছিল, অনেকটা পথ হেঁটে আসা ক্লান্ত সিংহীর দিকে সহযোগিতা এগিয়ে দিয়েছিল সেই গজরাজ। পড়শির দিকে যেভাবে বাড়িয়ে দিতে হয় সাহায্যের হাত, সে কথাই যেন মনে করিয়ে দিয়েছিল এ ছবি। যেন গোটা পৃথিবীকে সহাবস্থানের পাঠ দিতে দিতে দুই বন্যপ্রাণের লং মার্চ। পরে অবশ্য জানা যায়, এপ্রিল ফুল উপলক্ষেই বানিয়ে তোলা হয়েছিল এ ছবি। কী আশ্চর্য সত্যি, তাই না? যে মানুষ বন্ধুত্ব ভুলে গিয়েছে, ভুলে গিয়েছে কারও দিকে স্বার্থহীন হাত বাড়িয়ে দিতে, তার মতো বোকা আর কে? এ ছবি কি আসলে কাউকে বোকা বানাল, নাকি আসলে তা চিনিয়ে দিয়ে গেল আমাদের সেই বোকামির খোলসটাকেই? তেমনটাই হয়তো বলা চলে এই সাম্প্রতিক ছবিটির ক্ষেত্রেও। বরফ আর পাথরের রংহীনতার মাঝে একটুখানি রং হয়ে জেগে আছে যে কিশোরী, সে বোধ করি আমাদের বেরঙিন হয়ে থাকা মনগুলোকেও চিনিয়ে দিয়ে গেল। যেখানে পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা আর সহিষ্ণুতার রংগুলো মুছে যাচ্ছে ক্রমশ। সেই সত্যিটাই কি আসলে কাঙ্ক্ষিত, নাকি সত্যি হতে পারত সহাবস্থানের এই মিথ্যে ছবিগুলোই?
আরও শুনুন: রংচঙে ছবি নয়, আঁকার খাতা জুড়ে নেমে এসেছে বিধ্বস্ত পৃথিবী! মন ভালো নেই শিশুদেরও
এই সময়টা ভাইরাল ফিভারেরই। মিথ্যে ছড়ানোর তাড়া ক্রমশ ছেয়ে ফেলেছে আমাদের সোশালের দুনিয়া। সে সোশালের বোকাবাক্সে অবশ্য জুড়ে থাকার কোনও সামাজিকতা আসলে বেঁচে নেই। সেখানে এমন কিছু মিথ্যে বেঁচে থাকলই নাহয়! সোশাল দুনিয়ায় হিংসা ছড়ানোর মিথ্যে ছবি যখন আসল দুনিয়ায় সত্যি অশান্তির বীজ বোনে, সেই সময়ে নাহয় সোশালের জগতেই বেঁচে থাক এমন কোনও কোনও মিথ্যে ভালোবাসার ছবি। রক্তের লাল নয়, ভালোবাসার লাল রং ছড়িয়ে। তাতে নাহয় মানুষ মাঝে মাঝে বোকা হলই বা। কিছু কিছু বোকা বনে যাওয়া আদতে সুন্দর, তাই না?