মেয়েদেরকে এমন এক দাঁড়িপাল্লায় বারে বারে বসানো হয়ে থাকে বলেই, পুরুষের প্রতিও একটা পালটা তির হয়তো আসতেই পারে। কিন্তু এ কথা ভেবে দেখার, সেই পালটা তির কি আসলে এই সমস্যার যথাযথ সমাধান? যে প্রবণতা নারীকে পণ্যের চোখে দেখে তার অপমান করছে, সেই অপমানকে চেনার পর একই প্রবণতায় পুরুষের দিকেও পালটা অপমান ছোড়াও কি কাজের কথা?
‘স্বর্ণের নাম সুন্দরী, আর মাইনের নাম কার্তিক’, সেই কবে মজার ছলে লিখেছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়। বিয়ের বাজারে পাত্র আর পাত্রীকে যেভাবে পণ্যের মতোই মেপে নেওয়া হয়, সেই প্রবণতাকেই নিশানা করেছিল এ কথা। দিন বদলেছে, কিন্তু সেই প্রবণতা আদৌ পালটায়নি বিশেষ। এখনও পাত্রপাত্রী চাই-এর বিজ্ঞাপন দেখলে সে কথার আন্দাজ মেলে। বিশেষ করে সম্বন্ধ করে বিয়ের বাজারে মেয়েদের যেন দাঁড়িপাল্লাতেই চাপিয়ে দেওয়া হয়। তবে সম্প্রতি এক ভাইরাল বক্তব্যে আবার দেখা গেল উলটো ছবি। সেখানে দেখা গিয়েছে, নিজের জন্য পাত্র চেয়ে সোশাল মিডিয়াতেই কথা বলছিলেন এক তরুণী। সে পাত্রের কী কী গুণাবলি থাকা প্রয়োজন, তা বলতেও তিনি ভোলেননি। বছর ৩৭-এর ওই তরুণীর বার্ষিক আয় প্রায় ৪ লক্ষের কাছাকাছি। তবে তাঁর আশা, তাঁর হবু স্বামীর আয় যেন কোটির অঙ্ক ছুঁয়ে ফেলে। সাধারণ কোনও চাকরি করে বছরে কোটি টাকা রোজগার করা মোটেই সহজ কাজ নয়। তাই পাত্র হিসেবে চ্যাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট কিংবা চিকিৎসকের মতো পেশাকেই এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেবেন বলে বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করেছেন ওই তরুণী। উপরন্তু নিজস্ব বাড়িও থাকতে হবে ওই পাত্রের। আর তাঁর এই বক্তব্য ছড়িয়ে পড়তেই রসিকতায় মেতেছেন অনেকেই। অনেকেই এহেন দাবিদাওয়া করার বিষয়টিকে খুব একটা ভালো চোখে দেখেননি।
আরও শুনুন:
যিনি রাঁধেন, তাঁর ভোটে দাঁড়ানো মানা?
কিন্তু কথা হচ্ছে, বিয়ের সম্বন্ধের ক্ষেত্রে এমন ছবি কি নেহাতই অচেনা? তবে সাধারণত সেখানে তিরটি ঘুরে যায় মেয়েদের দিকেই। প্রকৃত গৌরবর্ণা, প্রকৃত সুন্দরী, গৃহকর্মনিপুণা, এমনই রাশি রাশি বিশেষণের মাপকাঠিতে যেন সেরা পণ্য বাছাই করতে নামে অনেক পাত্রের পরিবার। বিশেষ করে, পাত্রের আর্থিক যোগ্যতা যত বাড়ে, ততই উঁচু হয় মাপকাঠির পাল্লাও। যে কোনও মানুষের পক্ষেই এ ঘটনা যে রীতিমতো অপমানের, তা তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পাত্রী দেখা ও তাকে নাকচ করা নিয়ে যত গল্প শোনা যায়, সেখানে সেই অপমানের কথা মোটা দাগেই লেখা থাকে। কিন্তু শুধু কোনও মেয়েকেই অপমান করা হয় না এখানে। পাশাপাশি যে পুরুষের দাম তার চাকরি আর মাইনের উপর নির্ধারিত করছে তার নিজেরই পরিবার, সেখানে আদতে সেই পুরুষটিকেও একরকম অপমানই করা হচ্ছে বইকি। হ্যাঁ, সারাজীবন যার সঙ্গে কাটানোর কথা ভাবছেন, তিনি কেমন হবেন, তা ভেবে দেখা দরকার। কিন্তু সেক্ষেত্রে কোনও মানুষের বুদ্ধি, বিবেচনা কিংবা মানবিক গুণগুলিকে খতিয়ে দেখাই কি আরও বেশি জরুরি নয়? তার বদলে সমস্ত যাচাইয়ের অভিমুখটিই থাকছে রূপ বা অর্থের মতো বাহ্যিক বিষয়কে কেন্দ্র করে, এও কি খুব একটা বুদ্ধির পরিচয় দেয়?
আরও শুনুন:
বাবার পদবি ব্যবহার করতে লাগবে স্বামীর অনুমতি! এ দেশের মেয়েদের বড় হতে নেই?
মেয়েদেরকে এমন এক দাঁড়িপাল্লায় বারে বারে বসানো হয়ে থাকে বলেই, পুরুষের প্রতিও একটা পালটা তির হয়তো আসতেই পারে। এই বিজ্ঞাপন প্রসঙ্গেও তেমন কোনও কটাক্ষের ভাবনা থেকেই কথা বলা হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু এ কথা ভেবে দেখার, সেই পালটা তির কি আসলে এই সমস্যার যথাযথ সমাধান? যে প্রবণতা নারীকে পণ্যের চোখে দেখে তার অপমান করছে, সেই অপমানকে চেনার পর একই প্রবণতায় পুরুষের দিকেও পালটা অপমান ছোড়াও কি কাজের কথা? নাকি এই সমস্যাকে গোড়া থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করাই আরও বেশি জরুরি? যেখানে পুরুষ বা নারী, কাউকেই আর কেবল বাহ্যিক বিষয় দিয়ে মেপে নেওয়া হবে না, তেমনই এক গন্তব্যের কথা তো ভাবা যেতেই পারে। এই সাম্প্রতিক বক্তব্যটি ফের উসকে দিল সেই ভাবনাই।