বাংলা প্রবাদই বলে, জল বিনে চাতক মৈল রে। একফোঁটা জলের জন্য রোদঝলসানো আকাশে ‘ফটিকজল ফটিকজল’ ডেকে ঘুরে বেড়ানোই চাতক পাখির নিয়তি। কিন্তু মানুষের জন্যও যদি কখনও বরাদ্দ হয় তেমনই নিয়তি? গলা অব্দি শুকিয়ে যাওয়া তেষ্টায় যদি তাকেও জলের খোঁজে ফিরতে হয় কেবল? সত্যি বলতে, এই যে বেশ কিছুদিন ধরেই শিরোনামে বেঙ্গালুরুর জল সংকট, বাংলারও সেই অবস্থা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকেই, সেখানে কি তেমন আশঙ্কার ছবিই জাগছে না?
বলি একটু জল পাই কোথায়? এই প্রশ্নকে চিরন্তন করে রেখে গিয়েছে ‘অবাক জলপান’ নাটক। ‘জলের মতো সস্তা’, ‘জলের দর’ বলে যে জলকে একান্তই সুলভ করে রাখা হয়, সেই জল যে আসলে কতটা জরুরি, হাসির মোড়কে সে কথাও কিন্তু বলা আছে এখানে। এই যে হাসির ছলে জলের জায়গায় জলপাইয়ের খবর দেওয়া হয়, তাতে এই ইঙ্গিত থাকে যে, জলতেষ্টার সময় পানীয় জল না পেলে আদৌ হাসি পায় না। অসঙ্গতির কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথও বলেছিলেন, ‘তৃষ্ণার্ত হয়ে চাহিলাম এক ঘটি জল, তাড়াতাড়ি এনে দিল আধখানা বেল’, এ ঘটনা আসলে হাসি নয়, দুঃখেরই শামিল। জল যে সত্যিই জীবনের আরেক নাম, বাংলার প্রবাদে গানে গল্পে এভাবেই সে কথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। উপমা রূপকের আড়ালে সেখানে বোঝানো হয়েছে যে, জল যদি দুর্লভ হয়ে ওঠে কোনও পরিস্থিতিতে, তবে জল বিনে মানুষের ঠিক কেমন দুর্দশা হতে পারে।
আরও শুনুন:
World Water Day: অবাক জলপান! জলের দরে আর মেলে না জল
বাংলা প্রবাদই বলে, জল বিনে চাতক মৈল রে। চাতক পাখি, যে নাকি বৃষ্টির জল ছাড়া অন্য জল খেতে পারে না, তা সে যত তেষ্টাই পাক না কেন। তাও আবার যে-সে বৃষ্টি হলে চলবে না, স্বাতী নক্ষত্র থেকে ঝরে পড়া জলই হতে হবে নাকি। ফলে একফোঁটা জলের জন্য রোদঝলসানো আকাশে ‘ফটিকজল ফটিকজল’ ডেকে ঘুরে বেড়ানোই তার নিয়তি। কিন্তু মানুষের জন্যও যদি কখনও বরাদ্দ হয় তেমনই নিয়তি? গলা অব্দি শুকিয়ে যাওয়া তেষ্টায় যদি তাকেও জলের খোঁজে ফিরতে হয় কেবল? সত্যি বলতে, এই যে বেশ কিছুদিন ধরেই শিরোনামে বেঙ্গালুরুর জল সংকট, বাংলারও সেই অবস্থা হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকেই, সেখানে তো এমনই ছবি দেখা যাচ্ছে। রাজস্থান কি মরু অঞ্চলের অনেক জায়গায় যে জলের কষ্ট নিত্যসঙ্গী, সে কথাও তো আমাদের জানাই ছিল। এমনকি কৃষিজীবী বাংলার লোকগানেও রয়েছে জলের জন্য আকুল প্রার্থনা, আল্লা ম্যাঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই। ‘আয় বিষ্টি ঝেঁপে’-র প্রার্থনা মিটলে ধান মেপে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও রয়েছে বইকি। চাষি বলছেন, এই সরাবনেই আঘুন মাস, অর্থাৎ শ্রাবণের বৃষ্টিতে ফসল লাগালে তবে তো অঘ্রানে ফসল উঠবে, আর লাভের মুখ দেখবেন তিনি। জলের দাম জানা ছিল বলেই জলের সংকটের ছবিটি তুলে ধরেছিল সেকাল। বাংলার পুরনো প্রবাদ ঘেঁটে দেখলে মিলবে এমনই আশঙ্কার কথা- তেষ্টার সময় কাউকে জল না দিলে নাকি চাতক হয়েই ফিরতে হবে মেঘশূন্য আকাশে। আসলে, চাতক পাখি হওয়ার অভিশাপের নেপথ্যে আসল কথা এটাই, তেষ্টার সময় জল মিলবে না। সেই ভয় পুরো সমাজকেই এই বার্তা দিয়ে রাখে যে, জলের যত্ন করো। জল সংরক্ষণের সেই সাবধানবাণীটিকেই প্রবাদের মোড়কে জানিয়ে রেখেছিল পুরনো বাংলা।