তাঁরা নাকি কেবল রাঁধতেই জানেন, ভোটে লড়া তাঁদের কাজ নয়। লোকসভার আগে এহেন কটাক্ষের মুখেই পড়তে হচ্ছে মহিলা প্রার্থীদের। হ্যাঁ, লোকসভায় মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ হওয়ার পরেও। শুনে নেওয়া যাক।
কথায় বলে, যিনি রাঁধেন, তিনি চুলও বাঁধেন। কিন্তু যদি তিনি চুল বাঁধার বদলে অন্য কোনও কাজ করতে চান রান্নার পাশাপাশি? তাহলে দুটি কাজ একসঙ্গে করছেন বলে তাঁর বাহবা মিলবে তো? নাকি, সেই কাজটি কী হবে, তাও বেঁধে দেবে সমাজই? লোকসভা ভোটের মুখে মহিলা প্রার্থীদের নিয়ে এক মন্তব্যে উসকে উঠল সে ভাবনাই।
আরও শুনুন:
বাবার পদবি ব্যবহার করতে লাগবে স্বামীর অনুমতি! এ দেশের মেয়েদের বড় হতে নেই?
সম্প্রতিই, বিজেপির মহিলা প্রার্থীকে কটাক্ষ করতে গিয়ে কংগ্রেসের প্রবীণতম বিধায়ক শামানুর শিবশংকরাপ্পা বলে বসেছেন, “ওঁরা তো কেবল রান্নাঘরে খুন্তি নাড়তেই পারেন। জনতার দরবারে এসে কথা বলার সামর্থ্যও ওঁদের নেই।” আসলে ৯২ বছরের রাজনীতিকের লক্ষ্য ছিলেন কর্নাটকের দেবনাগরী লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী গায়ত্রী সিদ্ধেশ্বরা। কংগ্রেস নেতার বক্তব্য, বিজেপি প্রার্থী ভোটে জিতে নরেন্দ্র মোদিকে পদ্মফুল উপহার দিতে চান বটে, কিন্তু তিনি নির্বাচনী কেন্দ্রের সমস্যাগুলিই জানেন না। কংগ্রেস এই এলাকায় অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছে, এই দাবি করে বর্ষীয়ান নেতার কটাক্ষ, ওঁরা শুধু রান্না করতেই পারেন। এই মন্তব্যে মহিলাদের অপমান করা হয়েছে বলে সরব বিজেপি। পালটা জবাবে গায়ত্রী বলেছেন, ‘উনি এমনভাবে কথা বললেন, যাতে মনে হচ্ছে উনি চান মহিলারা শুধু রান্নাঘরেই থাকুন। আজকের মহিলারা কোন পেশার সঙ্গে যুক্ত নেই? মহিলারা কতটা এগিয়ে গিয়েছেন, উনি তা জানেন না।”
আরও শুনুন:
মেয়েদের দাম কত! শাসক থেকে বিরোধী, সব পথ শেষে মিলে যায় একই প্রশ্নে?
এ কথা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ওই প্রার্থী মহিলা না হলে এহেন মন্তব্য আসার জায়গা থাকত না। আর প্রশ্নটা সেখানেই। যেখানে একদিকে গোটা দেশের উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে সব দলই, আশ্বাস মিলছে আধুনিকীকরণেরও, সেখানে মহিলা মাত্রেই তাঁর সঙ্গে রান্নাঘরের সমীকরণ টানা হবে, এ ভাবনা কতখানি সঙ্গত? এই সময়ে দাঁড়িয়ে না রান্না কেবল মেয়েদের কাজ হয়ে আছে, না মেয়েরা কেবল রান্নার দক্ষতাতেই নিজেদের বেঁধে রেখেছেন। তাহলে কোনও মহিলা প্রার্থীর বিরোধিতা করতে গেলে সেখানে কেবলমাত্র এই প্রসঙ্গ টানা হবে কেন? রাজনৈতিক বিরোধিতার যুক্তিও তো রাজনৈতিক হওয়াই উচিত, তাই নয় কি? কোনও মহিলা রাঁধতে পারেন, তা বলে কি তাঁর ভোটে দাঁড়ানো মানা?
আর এখানেই উঠে আসছে সেই পুরনো বিতর্ক, যে, মহিলা সংরক্ষণ বিল আদতে মহিলাদের অবস্থান পালটাবে কি? হ্যাঁ, কিছুদিন আগেই সাড়ম্বরে সংসদে পাশ হয়ে গিয়েছে মহিলা সংরক্ষণ বিল। যা নিশ্চিত করছে, সংসদীয় গণতন্ত্রে ৩৩ শতাংশ অংশীদারিত্ব থাকবে মেয়েদের। একদিকে মোদি সরকার এই বিলের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দাবি করছে, অন্যদিকে ইতিহাস বলছে, ১৯৮৯ সালেই রাজীব গান্ধী সরকার পঞ্চায়েত ও পুরসভায় মহিলাদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ করার বিল এনেছিল। কিন্তু তারপরেও, মহিলাদের সম্পর্কে নেতাদের ভাবনার ধরনটি কি বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, আসলে বিল রয়ে গিয়েছে বিলের জায়গাতেই? তা আদৌ পিতৃতান্ত্রিক ধারণার কোনও বদল ঘটায়নি, যে ধারণার দরুন মহিলাদের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ মেনে নিতে বরাবরই অস্বস্তিতে পড়েছে এ দেশ। মেয়েদের ভোটাধিকার পেতেও কম লড়াই লড়তে হয়নি, ভোটে দাঁড়ানোর অধিকার মিলেছে আরও পরে। এ অবস্থান মেয়েদের জন্য বরাদ্দ নয়, এই মতেই দীর্ঘদিন অনড় ছিল সমাজ। ঠিক যেভাবে রান্নাঘরটিকেই মেয়েদের জায়গা বলে বরাদ্দ করা হয়েছিল। মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ হয়ে যাওয়ার পরেও যে এমনই ভাবনার সুর শোনা যাচ্ছে, তা কার্যত বিলটিকেও একরকম সংশয়ের মুখেই ঠেলে দিচ্ছে বলা যায়।