শ্রীগীতা বলে, কাজ করা উচিত ফলের আশা না করেই। মা ফলেষু কদাচন…। সত্যিই কি এভাবে মনকে তৈরি করা সম্ভব? কেমন করেই বা চিনে নেওয়া যায় নিষ্কাম কর্ম অনুশীলনের পথ!
কর্মই আমাদের ধর্ম। কাজ আমাদের করে যেতে হয় আজীবন। যার জন্য যে কাজ নির্দিষ্ট, তাকে সেটুকু করতেই হয়, নইলে এই বিশ্বমানবের প্রতি একজন মানুষ হয়ে মানুষের যা কর্তব্য, তা সে পালন করতে পারে না। এই যে আমাদের জীবন, সে তো আসলে একটি যজ্ঞেরই প্রতিরূপ। কতরকম নিত্যকর্তব্যের বিধান আমাদের জন্য স্থির হয়ে আছে। যে কর্মে তাই যার অধিকার, সেই কর্ম তাকে করতেই হবে।
শ্রী গীতা আমাদের বলছেন,
কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্মফল হেতুভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি।।
অর্থাৎ, কর্মেই আমাদের অধিকার, ফলে নয়। কর্ম সম্পাদনের ভিতর যেন ফলের আকাঙ্ক্ষা না থাকে। আবার ফলের আকাঙ্ক্ষা নেই বলে কর্মত্যাগ করবে, এমনটি হওয়ারওউপায় নেই। অর্থাৎ, কর্ম আমাদের করতে হবে, কিন্তুনিষ্কাম ভাবে। গীতা আমাদের সেই উপদেশই দিচ্ছেন। এখন, এই উপদেশ শুনেআমাদের সাধারণ মনে প্রশ্ন জাগে, ফলের আশা ত্যাগ করে এভাবে কর্ম করা কি সম্ভব? আর যদি সম্ভব হয়, তবে কীভাবেই বা নিজের মনকে তার জন্য প্রস্তুত করা যায়?
এর উত্তর খুঁজতে আমরা আবার গীতার-ই শরণ নেব। সেখানে যে নিষ্কাম কর্মের কথা বলা হয়েছে, তার জন্য তিনটি লক্ষণও নির্দিষ্ট করা হয়েছে। প্রথমটিই হল, ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জন, অর্থাৎ ফলের দিকে না-তাকিয়ে কাজ করে যাওয়া। কর্মের সিদ্ধি বা অসিদ্ধিতিতে যেন সমত্ব বুদ্ধি থাকে। দ্বিতীয় লক্ষণটি হল, কর্তৃত্বের অভিমান ত্যাগ। অর্থাৎ, কর্মের ভিতরে যে আমি বসে আছে, তাকে সরিয়ে রাখতে হবে। ত্যাগ করতে হবে অহং। আর, তৃতীয়টি হল, ঈশ্বরে সর্বকর্ম অর্পণ। অর্থাৎ আমাদের এই কাজ যে ঈশ্বরেরই অর্চনা – এই বোধ মনের মধ্যে জাগিয়ে তোলা। এইভাবে যদি কর্ম করা হয়, তবেই তাকে আমরা বলতে পারি যজ্ঞার্থ কর্ম।
এই যে কর্মের জন্য এত কথা বলা হচ্ছে গীতায়, তা তো এমনি এমনি নয়। যে কর্ম আমাদের সারাক্ষণের, অথচ তাতে অহং যেন না এসে ধরা দেয়, এরকম অনুশীলন তো সহজ নয়। তাই গীতা নানাভাবে আমাদের কর্ম সম্বন্ধে সচেতন করছেন।মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কর্মকে কেবল কর্তব্যের খাতিরে কাজ হিসেবে দেখলে ভুল করে ফেলা হবে। কেননা, সেখানেই তো সামনে এসে দাঁড়ায় আমি। আর, আমির উপস্থিতি মানেই পথরোধ করে অহং। যেখানে অহং সেখানেই বিপত্তি। আমির আবরণ মোচন করলেই দেখা মেলে যে ‘অন্য আমি’র, সেই-ই তো দেয় ঈশ্বরের সন্ধান। তাই গোড়াতেই সরিয়ে রাখতে হবে আমিত্বকে। আমির বিনাশ হলে, অহংবুদ্ধি অতিক্রম করতে পারলেই কর্ম হয়ে উঠবে নিষ্কাম কর্ম।
তখন মনে এই বোধ জারিত হবে যে, কর্ম সর্বভূতের হিতার্থে। আমাদের এই কর্ম, কেবল আমার কর্ম নয় – এই অনুভব যাঁর মনে জেগে থাকে, তিনিই উঠতে পারেন সর্বভূতে সমদর্শী। একের মধ্যে তিনি দেখতে পান বহুকে, বহুর মধ্যে দেখতে পান সেই পরম ‘এক’-কে। এই দেখার চোখ তাঁরই ফোটে, চোখের দেখার বাইরে যিনি অন্তরের আলোকে দেখতে শেখেন। আর, তখনই তাঁর কর্ম হয়ে ওঠে নিষ্কাম কর্ম, তিনি হয়ে উঠতে পারেন কর্মযোগী।
তাহলে, আমরা জানলাম, যিনি কর্মযোগী, তিনি জানেন, তাঁর কর্ম বিশ্বমানবের জন্য। সর্বভূতের জন্য। সর্বভূতে তিনি এক ঈশ্বরকেই দর্শন করেন – ‘যেন সর্বমিদং ততং’- অর্থাৎ, তিনি সর্বভূতময়। কর্মযোগী জানেন, এই কর্ম তাঁকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছেন প্রকৃতি। এর নেপথ্যে ক্রিয়াশীল এক ইচ্ছাশক্তি, সৃষ্টিশক্তি। সৃষ্টিরক্ষার জন্যই তাই সমস্ত কর্ম চলেছে নিজস্ব নিয়মে। আর সেই ইচ্ছেশক্তিই প্রত্যেককে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে সকলের জন্য নির্ধারিত নির্দিষ্ট কাজ। এভাবেই হচ্ছে সৃষ্টিরক্ষা। সুতরাং কর্মযোগী তাঁর কর্ম নিবেদন করেন ঈশ্বরকে, সর্বভূতের মঙ্গলের জন্য। তিনি জানেন, ‘স্বকর্মণা তমভ্যর্চ্য সিদ্ধিং বিন্দতি মানবঃ’ – নিজের কর্তব্যপালনের মাধ্যমেই ঈশ্বরের অর্চনা করে জীবনে সিদ্ধিলাভ করা সম্ভব।
আরও শুনুন: Spiritual: শাস্ত্রমতে কখন সত্যের থেকে মিথ্যে হয়ে ওঠে শ্রেয়?
এই মনোভাব নিয়ে যদি কর্মে প্রবৃত্ত হতে পারি আমরা, তবে আর ফলাকাঙ্ক্ষা আমাদের বিচলিত করে না। কর্তৃত্বের অভিমান এসে আমাদের পথ আটকে দাঁড়ায় না। তখন সমস্ত কর্মই আমরা ঈশ্বরে ন্যস্ত করতে পারি। আমাদের সাধক কবি বলেন, তোমার কর্ম তুমি করো মা, লোকে বলে করি আমি। কখনও আবার বলেন, তুমি যন্ত্র আমি যন্ত্রী, যেমনি চালাও তেমনি চলি। এই ভাবটুকুই প্রকৃত সত্য। কর্মের ভিতর থেকে আমির অহং, ফলের আশা ত্যাগ করে তা যদি ঈশ্বরে অর্পণ করা যায়, সেভাবেই যদি নিয়ত তৈরি রাখা যায় মনকে- তবে শ্রীগীতা যে নিষ্কাম কর্মের কথা বলে, তা সম্পাদনের পথেই আমরা এগিয়ে যেতে পারি। কর্ম তখন আর কোনও বন্ধন হয়ে দাঁড়ায় না, বরং কর্মের মধ্যেই তখন নিহিত থাকে মানুষের মুক্তি।