নির্বাচনী বন্ডের ক্ষেত্রে ‘অর্থমন্ত্রীর স্বামী কী বলেছেন’-এর পরিবর্তে আলোচনার কেন্দ্র হওয়া উচিত ছিল, দেশের একজন প্রখ্যাত পলিটিক্যাল ইকনমিস্ট কী বলেছেন। জোরটা পরিচয়ে নয়, বক্তব্যে পড়া বেশি জরুরি। তবু এই পরিচয়ের মোহ আমাদের এমন ভাবে ঘিরে থাকে যে অর্ধেক কথা আমাদের কানে ঢোকে না। রঘুরাম রাজনের কথা সেই জন্যই কি আমরা শুনেও শুনলাম না?
নির্বাচনী বন্ড ঘিরে ভারতীয় রাজনীতিতে অস্বস্তির ভিতর একেবারে মোক্ষম বোমাটি ফেলেছেন পরকলা প্রভাকর। বলেছেন, এটি হল বিশ্বের বৃহত্তম দুর্নীতি। তিনি পলিটিক্যাল ইকনমিস্ট, ফলত এ-কথা বলতেই পারেন। তবে এখানে গুরুত্ব পেয়ে গিয়েছে তাঁর আর-একটি পরিচয়, তিনি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের স্বামী। নির্বাচনী বন্ড ও তাতে বিজেপির সবথেকে লাভবান হওয়ার প্রসঙ্গে স্বাভাবিক ভাবেই নির্মলার সঙ্গে তাঁর মতের মিল হয়নি। পূর্বসূরি অরুণ জেটলির জমানায় যে বন্ডের সূত্রপাত, তার ভালো দিকগুলিই তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন নির্মলা। পরকলা প্রভাকর অবশ্য কোনও রাখঢাক করেননি। সোজা-সাপটা বলে দিয়েছেন যে, নির্বাচনী বন্ডের দুর্নীতির জন্য ভোটাররাই চরম শাস্তি দেবে বিজেপিকে। এখন এই দুই ভিন্নসুর নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে বিভিন্ন মহলে। যেহেতু সামাজিক পরিচয়ে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী। ঘুরেফিরে তাই উঠে এসেছে সেই পুরনো প্রশ্ন, কোনও একটি বিষয়ে স্বামী ও স্ত্রীর কি ভিন্নমত থাকতে পারে না? নাকি তা থাকা রাজনীতিতে বেমানান!
আরও শুনুন: ভোটের মুখে বড় বড় নেতার থেকে ফোন পাচ্ছেন? সাধু সাবধান!
বছর দুয়েক আগে এ-প্রশ্ন করেছিলেন খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ্। বিজেপি সরকারের অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে সেবার সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন পরকলা প্রভাকর। চর্চা জরালো হতেই মুখ খুলেছিলেন তিনি। তাঁর বক্তব্য ছিল যে, যাঁরা এ নিয়ে সমালোচনা করছেন, তাঁরা কি চান না যে, ভারতবর্ষে স্বামী স্ত্রীর ভিন্নমত পোষণের অধিকার থাকুক? ভিন্নমত থাকা যে অত্যন্ত স্বাভাবিক তা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, এই ধরনের সমালোচনা মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়। গণতন্ত্রের জন্য তো নয়-ই। কেননা, একটা গণতান্ত্রিক পরিসরে সকলেরই নিজস্ব মত জানানোর অধিকার আছে। বিরোধিতারও অধিকার আছে। একজন ব্যক্তির স্ত্রী অর্থমন্ত্রী বলেই তিনি যে ভিন্নমত পোষণ করতে পারবেন না, বা করলে তা নিয়ে সমালোচনা হবে, এই ব্যাপারটি মোটেও সুস্থ অনুশীলন নয় বলেই মত ছিল তাঁর। সত্যি বলতে, এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। যদিও সচরাচর তা হয় না। আর তাই যখন অর্থমন্ত্রীর স্বামী খোদ শাসকদলের সমালোচনা করেন, তখন আবার আলোচনা শুরু হয়ে যায়।
খেয়াল করলে দেখা যাবে, কর্মক্ষেত্র ও পরিবার যে দুটি আলাদা পরিসর, সেই গণ্ডি অনেক সময়ই মানা হয় না। দুটির ধারণা এমন মিলেমিশে থাকে যে, ব্যক্তিকে শুধু তাঁর কাজ দিয়ে চিহ্নিত করা থেকে দূরে সরে যাওয়া হয়। বরং তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক প্রসঙ্গ চর্চায় চলে আসে। তবে, নির্মলা সীতারমন ও তাঁর পরিবার এই দিকটাকে আলাদা করেই রাখেন বরাবর। বছরখানের আগে যখন অর্থমন্ত্রীর মেয়ের বিয়ে হয়, তখন দেখা হয়েছিল সে বিয়েবাড়ি মোটের উপর সাদামাটা। পারিবারিক স্বজন বন্ধুরাই সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন। রাজনৈতিক নেতৃবর্গের উপস্থিতি বিশেষ দেখা যায়নি। এর উলটোটা হওয়াই যেন স্বাভাবিক ছিল। প্রসঙ্গত এর একটি ঘটনার দিকেও চোখ রাখা যেতে পারে। অর্থমন্ত্রী এবারে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। কারণ হিসাবে জানিয়েছেন যে, ভোটে লড়ার মতো অর্থবল তাঁর নেই। যেখানে টিকিট না পেয়ে আত্মহত্যার মতো ঘটনা পর্যন্ত ঘটে, সেখানে এই সিদ্ধান্ত চমকে দেয় বইকি! সর্বভারতীয় এক সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, অর্থমন্ত্রীর জামাই দীর্ঘদিন পিএমও-তে কর্মরত ছিলেন। তাই বলে তাঁকে জামাই হিসাবে মেনে নিতে পরকলা প্রভাকরের অসুবিধা হয়নি। হওয়ার কথাও ছিল না।
আসলে ব্যক্তির স্বাধীনতা, নিজস্ব মতামত নিয়ে প্রায়শই আলোচনা হয় বটে। তবে, থেকে থেকেই সেই সব আলোচনার অভিমুখ ব্যক্তির জীবনের দিকে ঘুরে যায়। তা একেবারে অপ্রত্যাশিত হয়তো নয়। তবে, দুটোকে আলাদা করে দেখতে শেখাই বাঞ্ছনীয়। রাজনীতিতে শুধু কেন, এমনকী পারিবারিক ক্ষেত্রেও স্বামী-স্ত্রী-র ভিন্নমত থাকতে পারে। দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের ক্ষেত্রে এই অবস্থান তো ভিন্ন হতেই পারে। তাই, নির্বাচনী বন্ডের ক্ষেত্রে ‘অর্থমন্ত্রীর স্বামী কী বলেছেন’-এর পরিবর্তে আলোচনার কেন্দ্র হওয়া উচিত ছিল, দেশের একজন প্রখ্যাত পলিটিক্যাল ইকনমিস্ট কী বলেছেন। জোরটা পরিচয়ে নয়, বক্তব্যে পড়া বেশি জরুরি। তবু এই পরিচয়ের মোহ আমাদের এমন ভাবে ঘিরে থাকে যে অর্ধেক কথা আমাদের কানে ঢোকে না।
রঘুরাম রাজনের কথা সেই জন্যই কি আমরা শুনেও শুনলাম না? সম্প্রতি তিনি দেশের অর্থনীতি নিয়ে যে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তার গুরুত্বও কিন্তু কম নয়। পরিচয় পেরিয়ে সে কথায় কি আমরা কান দেব?